‘১৯৭১-এ দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। সবকিছু ত্যাগ করে দেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। বহু কষ্ট ও ত্যাগ-তিতিক্ষার পর দেশ স্বাধীন হলো। মুক্তিযোদ্ধা নামে পরিচিত হলাম। বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার কিছুদিন পর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা নামের সম্বোধনে বুকের মধ্যে কেমন যেন এক অজানা-অচেনা অনুভূতি এসে কাজ করতে লাগল। নিজেকে একেবারেই গুটিয়ে ফেললাম। তারপর দেখতে দেখতে ৩৩ বছর কেটে গেল। কিন্তু হঠাৎ করেই কেন যেন নিজের অজান্তে মনে হলো, আর কিছুদিন পর মানুষ হয়তো মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত দিনগুলোর কথা মনে রাখবে না। মনে রাখবে না স্বাধীনতার ইতিহাস। মনে খুব কষ্ট লাগে, একাত্তরের ওপর রচিত গ্রন্থগুলোতে নৌ-কমান্ডোদের অবদান নিয়ে তেমন কোনো কিছু লেখা হয়নি বলে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাঙালির কাছে নৌ-কমান্ডোদের অবদান কি তবে অজানাই থেকে যাবে এবং হারিয়ে যাবে প্রাণবাজি রাখা আত্মঘাতী বাহিনীর [সুইসাইডাল স্কোয়াড] যুদ্ধের ইতিহাস? এই কষ্টে মনের ভেতর থেকে ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা টেনে বের করে এনে লিখতে বসলাম মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডো হিসেবে অংশগ্রহণের কাহিনি। মনে হলো, জাতির কাছে, নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা-প্রাপ্তির দলিল হিসেবে এর ইতিহাস রেখে যাওয়ার দরকার—দরকার সময়ের কাছে নিজের ঋণ শোধ করবার দায় থেকে মুক্তি। এই ইতিহাস লিখতে গিয়ে বারবার মনে পড়েছে, বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবীর একটি উক্তি—‘সবার ভাগ্যে মুক্তিযুদ্ধ আসে না’। আমি আরও অনেকের মতো সত্যিই ভাগ্যবান যে, শত্রুর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম। আমি ডায়েরি লিখি না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঘটে যাওয়া ঘটনা স্মৃতি থেকে লিপিবদ্ধ করা সহজ কাজ নয়। তবুও আমি চেষ্টা করেছি ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে সমস্ত ঘটনাবলি উল্লেখ করতে। সেদিনকার সমস্ত ঘটনাই আমার স্মৃতির আকাশে এখনও জ্বলজ্বল করছে। মনে হয়, এই তো সেদিনের ঘটনা। ঘটনার বর্ণনায় আমি কোনো অতিশয়োক্তি করার চেষ্টা করিনি। কোনো কিছু অতিরঞ্জিত করে বলার চেষ্টাও করিনি। সত্যের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে মুক্তিযুদ্ধের মহান অর্জনগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এ-ক্ষেত্রে স্মৃতি কখনও কখনও প্রতারণা করে থাকতে পারে, কিন্তু সত্য কিছুতেই আমাকে প্রতারণা করেনি—এই বিশ্বাস নিয়ে আমি এ গ্রন্থটি রচনা করেছি। স্মৃতি থেকে লেখা ত্রুটির কারণে এই গ্রন্থের কোনো অংশ যদি কারও মনে সামান্যতম আঘাত দিয়ে থাকে, তাহলে সেই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য আমি একান্ত ক্ষমাপ্রার্থী।’
Title
মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডো : পলাশী, কর্ণফুলী ও কলকাতা