এ গ্রন্থটি গবেষণা পরিচালনা ও প্রকাশনা দপ্তর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ থেকে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) ও বৃহৎশক্তিবর্গের নৌকূটনীতি’ শীর্ষক আমার ২০২০ সালে সম্পাদিত গবেষণা কর্মের সংশোধিত ও পরিমার্জিত রূপ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুুদ্ধত্তর (১৯৩৯-১৯৪৫) কালে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ এশিয়া ও আফ্রিকায় তাদের উপনিবেশসমূহ গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এটির ধারাবাহিকতায় দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগষ্টে পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশসহ) ও ভারত নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহ পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান নামে অভিহিত করা হয়। সদ্য স্বাধীন হওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনীতি ও ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণ শুরুতেই রাজনৈতিক বঞ্চনা, অর্থনৈতিক শোষণ ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার হন। এসব অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির তীব্র প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), ছাত্র আন্দোলন (১৯৬২), ছয় দফা আন্দোলন (১৯৬৬), আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন (১৯৬৮) এবং গণ অভ্যূত্থানের (১৯৬৯) সৃষ্ঠি হয়।
বিশেষত ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যূত্থানে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সরকার বিরোধী আন্দোলন গণজোয়ারের সৃষ্ঠি করে। এ সকল আন্দোলনের অনিবার্য পরিণতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১)।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭২ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনীর নির্যাতন, গণহত্যা, লুন্ঠন ও ধর্ষণ প্রতিরোধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধে বাংলাদেশের স্থল মুক্তিযোদ্ধা, নৌকমান্ড ও বিমান বাহিনী অংশগ্রহণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে সুশৃংখলভাবে পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এসব সেক্টরের মধ্যে সমুদ্র বন্দর, নদীবন্দরসহ নৌপথসমূহ নিয়ে গঠিত ১০ নং সেক্টরে নৌকমান্ডোরা যুদ্ধ করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর অস্ত্র, সেনা, রসদ, গোলাবারুদ, ঔষধ প্রভৃতি সরবরাহের ইধপশ ঁঢ় খরহব নৌপথ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশে^র সমর্থন আদায় ও কৌশল নির্ধারণে নৌকূটনীতির (ঘধাধষ উরঢ়ষড়সধপু) ভূমিকাও অনস্বীকার্য।
মার্কিন নৌবিশারদ আলফ্রেড মাহান (১৮৪০-১৯১৪) তাঁর ১৬৬০-১৭৪৩’ গ্রন্থে পররাষ্ট্রনীতিতে নৌকূটনীতি সম্পর্কে আলোচনা করেন।
বিশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিতে নৌকূটনীতি নূতন মাত্রা সংযোজন করেছে। এই কূটনীতির মধ্যে সহযোগিতামূলক কূটনীতি ও বলপ্রয়োগিক কূটনীতি লক্ষ্য করা যায়।
১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে রক্ষা ও নতুন মিত্র চীনকে আশ্বস্ত করার জন্য ‘বলপ্রয়োগিক কূটনীতি’র আশ্রয় নেয়। মার্কিন নৌবহর ‘টাস্কফোর্স-৭৪’ ভারত মহাসাগরে যাত্রা করে এবং ১৬ ডিসেম্বর শ্রীলংকার উত্তর পূর্ব দিকের সমুদ্রে নোঙ্গর করে।
অপরদিকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ১৬টি নৌযানের বিশাল বহর ভারত মহাসাগরে প্রেরণ করে। ব্রিটিশ নৌবহরের ঈগল, এলবিয়নসহ অন্যান্য নয়টি ছোট বড় জাহাজ ভারত মহাসাগরে ছিল।
ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজও ভারত মহাসাগরে তৎপর থাকে এবং বঙ্গোপসাগরে নৌ অবরোধ সৃষ্ঠি করে। বিশ শতকের রাজনীতিতে স্নায়ু যুদ্ধকালীন বিশ্ব মার্কিন ও রুশ ব্লকে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
এ পটভূমিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও বহির্বিশ্বের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপে ‘আর্ন্তজাতিক সংকট’ এ রূপ নেয়। এমন পরিস্থিতিতে পরাশক্তি সমূহের নৌকূটনীতিতে রুশ-ভারত কূটনীতি সফল হয়।
বাঙালি মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণ, নৌকমান্ডোদের সাড়াঁশি অভিযান এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর চূড়ান্ত যুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতার গতিপথকে তরান্বিত করেছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসর্মপনের মধ্যদিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটে। গবেষণা কর্মটি সম্পাদনে সহযোগিতা করার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, গবেষণা পরিচালনা ও প্রকাশনা দপ্তর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পরিচালক ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, বর্তমান পরিচালক ও আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল ফারুক এবং বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিউল আযম প্রমুখকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের আমার শিক্ষক ও সহকর্মী অধ্যাপক ড. সেকান্দার চৌধুরী, অধ্যাপক ড. বশীর আহমদ, অধ্যাপক ড. সাবিনা নার্গিস লিপি প্রমুখের সার্বক্ষনিক সহযোগিতা, পরার্মশ ও অনুপ্রেরণায় গবেষণা কর্মটি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সম্মানিত ডিন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির এবং অধ্যাপক ড. আব্দুর রহিম প্রমুখ আমাকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এম.ফিল গবেষক এবং আমার স্ত্রী রোজিনা আক্তার চৌধুরীকে সর্বক্ষেত্রে পরামর্শ ও সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
আমার গবেষণা পূর্ণতাদানের ক্ষেত্রে যে সকল গ্রন্থাগার, সংস্থা, অফিস, সংগ্রহশালা ও বিশেষ প্রতিষ্ঠান সহায়তা প্রদান করেছে সেগুলি হল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ঢাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঢাকা, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রধান কার্যালয়, ঢাকা, এশিয়াটিক সোসাইটি গ্রন্থাগার, ঢাকা, জাতীয় গ্রন্থাগার ও আর্কাইভস, বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগার, ঢাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, ন্যাশনাল লাইব্রেরী, কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ আর্কাইভস, কলকাতা, এশিয়াটিক সোসাইটি লাইব্রেরী, কলকাতা, যাদবপুর বিশ^বিদ্যালয় লাইব্রেরি, কলকাতা প্রভৃতি। এ সকল প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ঠ সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞ জানাই। গবেষণা কর্মটি চলাকালীন সময়ে
এ গ্রন্থটি প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করায় কারুবাক প্রকাশের প্রকাশক গোলাম কিবরিয়া, আমার বড় ভাই ও অগ্রণী ব্যাংক-বাংলাদেশ শিশু একাডেমি শিশু সাহিত্যিক পুরষ্কার ১৪১৪ বঙ্গাব্দ প্রাপ্ত শিশু সাহিত্যিক রমজান মাহমুদসহ প্রকাশনাটির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট আমি কৃতজ্ঞ। গ্রন্থটি বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বাংলাদেশ স্টাডিজের বিষয়াবলিকে সমৃদ্ধ করবে। বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি কলেজ এবং বিশ^বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন ও গবেষণায় বিশেষ সহায়ক হবে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কৌতুহলী পাঠক ও গবেষকের উপকারে আসবে বলে আমি মনে করি।