প্রসঙ্গ-কথা: বাংলা একাডেমী নজরুল জন্মশতবার্ষিক উৎসবের পরপরই কবির ইতােপূর্বে বাংলা উন্নয়ন বাের্ড ও বাংলা একাডেমী প্রকাশিত রচনাবলীর একটি কালক্রমিক, পরিবর্ধিত, পরিমার্জিত ও অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ বিন্যাস ও নবসংযােজনযুক্ত নতুন সংস্করণ প্রকাশের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে। কারণ, নজরুল এমন এক বিস্ময়কর প্রতিভা ও বিপুলপ্রজ কবি যে, স্বল্পসময়ের সাহিত্য জীবনেও তাঁর রচনাসংখ্যা বেশুমার ; এবং সেই অবিরল ধারায় সৃষ্ট রচনা কবি কখন, কোথায়, কীভাবে লিখেছেন তার হদিস পাওয়া যেমন সহজ নয়, তেমনি তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেছেন কি-না সে সম্পর্কেও নিশ্চিত সংশয় আছে। ধারণা করা হয়, তাঁর সে-সব বিপুল রচনার একটা উল্লেখযােগ্য অংশ বিভিন্ন জনের সংগ্রহে অগ্রন্থিত অবস্থায় থেকে গিয়েছিল ; এবং কিছু রচনা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও তা সংগৃহীত না হওয়ায় কোনাে গ্রন্থভুক্ত হয়নি। জন্মশতবার্ষিক অনুষ্ঠানের পর এদিকে লক্ষ্য রেখে কবির রচনাবলীর একটি পরিপূর্ণ ও বিশুদ্ধ সংস্করণ প্রকাশের জন্য বাংলা একাডেমী ২০০৫ সালে নজরুল রচনাবলী জন্মশতবর্ষ সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ-কাজে কবি আবদুল কাদিরের সুদক্ষ সম্পাদনায় প্রকাশিত আদি নজরুল রচনাবলীর ভিত্তিমূলক সংস্করণ, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে গঠিত সম্পাদনা পরিষদের তত্ত্বাবধানে চারখণ্ডে বাংলা একাডেমী প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির নজরুল ইসলামের রচনাসমগ্র এবং নজরুলের বিভিন্ন গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ ও তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের বিভিন্ন সংস্করণের পাঠপর্যালােচনার পর সম্পাদকমণ্ডলী বর্তমান সংস্করণের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। নজরুল রচনাবলির দ্বাদশ খণ্ড মূলত নজরুলের হস্তলিপি, আলােকচিত্র ও প্রতিকৃতির প্রতিলিপির সংকলন। নজরুল রচনাবলীর বর্তমান সংস্করণ প্রস্তুত করার ব্যাপারে নজরুল-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম যে-নিষ্ঠায় সামগ্রিক কাজের তত্ত্বাবধান করেছেন এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তা অতীব প্রশংসনীয়। কবিসমালােচক প্রবন্ধকার আবদুল মান্নান সৈয়দ, অধ্যাপক আবুল কালাম মনজুর মােরশেদ ও অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক তাঁদের স্ব স্ব কাজে যে আন্তরিক নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন সেজন্য তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। এ গ্রন্থ প্রকাশের আগেই অন্যতম সম্পাদক আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রয়াত হয়েছেন। তিনি এই গ্রন্থ দেখে যেতে পারলেন না। এ জন্য আমরা গভীরভাবে মর্মাহত।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, সুরকার ও প্রবন্ধকার। নজরুলের বাল্যকাল কেটেছে দুঃখ-দুর্দশায়। তাই তাঁর ডাকনাম ছিলো দুখু মিয়া। তাঁর বৈচিত্র্যময় শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে। পিতৃহীন হওয়ার পর তিনি পড়ালেখা ছেড়ে যোগ দেন লেটোর দলে, যেখান থেকে তিনি কবিতা ও গান রচনার কৌশল রপ্ত করেন। পরবর্তীতে এক বছর ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে পড়ে পুনরায় চুরুলিয়ায় রানীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন, এবং সেখানে তিন বছর অধ্যয়ন করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগেই তাকে পড়ালেখা ছাড়তে হয় যুদ্ধে যোগদানের জন্য। যুদ্ধের দিনগুলোতে নানা জায়গায় অবস্থান করলেও তার করাচির সৈনিকজীবনই উল্লেখযোগ্য, কেননা সেসময়েই তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ নামক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমূহ’র বিষয়বস্তু বিবিধ। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এর বই-এ সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণা এবং সাম্যবাদের ধারণা প্রকটভাবে স্থান করে নিয়েছে। রাবীন্দ্রিক যুগে তার সাহিত্য প্রতিভা উন্মোচিত হলেও তার সৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমগ্র এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘রিক্তের বেদন’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘প্রলয়শিখা’ ইত্যাদি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নজরুল ‘সাপ্তাহিক লাঙল’, দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।