একদিন যে পথিক নীরবে পথ চলা শুরু করেছিলো মেঠোপথের আইলে, অজপাড়াগাঁয়ের কাদামাটির রাস্তায়, বিষখালী বলেশ্বরের উজানে গুণ টেনে, সে এখন পথ চলে যান্ত্রিক শহরে পিচঢালা পথে ব্যস্ত মানুষের কোলাহলে। একদা যার ঘুম ভাঙতো ভোরের আজান শুনে কিংবা দোয়েল শ্যামার শিসে, আজ সে সারাক্ষণ শোনে বিরক্তিকর গাড়ির শব্দ। যার বিহঙ্গমন মাতাল থাকতো হাসনাহেনা শিউলি বকুলের ঘ্রাণে, সোঁদা মাটির গন্ধ যার প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিশে যেতো ধমনীর শিরা উপশিরায়, শহরের বিষাক্ত কার্বনে আজ তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত নির্জীব।
টুপটাপ বৃষ্টিতে ভিজে আউশের ক্ষেতে যে তুলতো শাপলা শালুক, খালে বিলে পুকুরে মাছ ধরা ছিলো যার প্রাণের নেশা, পাখির বাসার খোঁজে সারাদিন যে ঘুরে বেড়াতো বনে বাদাড়ে, হাডুডু ডাংগুলি দাড়িয়াবান্দা বৌচি ফুটবল খেলায় যে ছিলো মধ্যমণি, গাঁয়ের নির্জন পথে কিংবা খোলা মাঠে যেতে যেতে যে গান গাইতো হেঁড়ে গলায়, সে এখন নীরস ইট লোহার খাঁচায় চার দেয়ালের মাঝে বন্দী। স্বপ্নের ভেলায় চড়ে শৈশব কৈশোরের স্মৃতির মাঠে ঘুরে বেড়ায় তার চিরচঞ্চল হৃদয়। একদিন ছায়া সুনিবিড় মিরুখালীর পাড়াগাঁয়ে যার ছিলো সরব বিচরণ, ঘুড়ি উড়ানো মার্বেল খেলায় যার কোনো জুড়ি ছিলো না, আজ তাকে খেলার আসরে কেউ ডাকে না।
পথ চলতে চলতে ক্লান্ত পথিক এক সময় পথ হারিয়ে ফেলে। কোথা থেকে চলার শুরু, কোথায় এসেছে, কোথায় যেতে হবে, পথিকের কিছুই মনে নেই। সামনে দিগন্ত প্রসারিত পথ, যেতে হবে বহুদূর, গন্তব্য অচেনা। সুদীর্ঘ এ পথের বাঁকে বাঁকে কতো স্মৃতি, হৃদয়ে জমানো কতো অব্যক্ত ব্যথা বেদনার গল্প। পথিকের পিছু ফেরার কোনো অবকাশ নেই। তার হৃদয় মাঝে একাকীত্বের কষ্ট, স্মৃতির কষ্ট, হারানোর কষ্ট, চাওয়া না পাওয়ার কষ্ট। এইসব নানাবিধ কষ্টের কথাগুলোই পথিক বলতে চেষ্টা করেছে ছন্দে কবিতায় ও গানে। কষ্ট বুকে পাথর চেপে জীবনের সাঁঝ বেলায় অনন্ত যাত্রা পথে সঙ্গীবিহীন মুসাফির শুধু একলা পথিক, উদাসী পথিক।