বলা হয়ে থাকে, কমরেড মাও সে তুং যদি মহান চীন বিপ্লবের কান্ডারি না হয়ে শুধু কবিতা লিখতেন, তাহলেও তাঁর কবিতা বিশ্বসাহিত্য অনেক স্মরণীয়-বরণীয় কবির সঙ্গে শীর্ষে অবস্থান করত এবং যা এখনো অবিস্মরণীয়। কেননা, তাঁর কবিতা শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে মাওদের যে অঙ্গীকার, তা তাঁর কবিতায় যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি তাঁর ভাষ্যেও পরিস্ফুট। তিনি বলেছেন: ‘যদিও মানুষের সামাজিক জীবনই সাহিত্য ও শিল্বকলার একমাত্র উৎস এবং বিষয়বস্তু দিক থেকে অতুলনীয়ভাবে সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত, তবুও মানুষ কেবল জীবনকে নিয়েই সন্তুষ্ট নয়, মানুষ সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রয়োজনও অনুভব করে। এর কারণ কী? কারণ, যদিও জীবন এবং সাহিত্য ও শিল্পকলা উভয়ই সুন্দর, তবুও সাহিত্য ও শিল্পকলায় জীবনের যে রূপ প্রতিফলিত হয়, তা হতে পারে এবং হওয়া উচিত সাধারণ বাস্তব দৈনন্দিন জীবনের চেয়ে আরও উচ্চতর, আরও তীব্র, আরও কেন্দ্রীভূত, আরও বৈশিষ্ট্যমূলক ও আদর্শের আরও কাছাকাছি এবং সেই জন্যই ঢের বেশি বিশ্বজনীন। বিপ্লবী শিল্প-সাহিত্যের উচিত বাস্তব জীবন থেকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের চরিত্র সৃষ্টি করা এবং ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাছে জনগণকে সাহায্য করা। দৃষ্টান্তস্বরূপ, একদিকে রয়েছে অনাহারে, শীতে ও অত্যাচারে জর্জরিত মানুষ, আর অন্যদিকে রয়েছে সেসব লোক যারা তাদেরই সমাজের মানুষকে শোষণ ও নির্যাতন করে। এ রকম ঘটনা সব জায়গাতেই ঘটে এবং মানুষ এগুলোকে গতানুগতিক বলে মনে করে। লেখক ও শিল্পীরা এই প্রাত্যহিক ঘটনাগুলো কেন্দ্রীভূত করে থাকেন, এগুলোর ভেতরকার দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামকে বৈশিষ্ট্য দান করেন এবং এমন সাহিত্য-শিল্প সৃষ্টি করেন, যা জনগণকে জাগিয়ে তোলে, তাঁদের ঐক্যবদ্ধ হতে এবং সংগ্রাম করতে অনুপ্রাণিত করে। এ ধরনের সাহিত্য-শিল্প ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন হতে পারে না, অন্ততপক্ষে কার্যকরভাবে ও দ্রুত সম্পন্ন হতে পারে না....’ [মাও সে তুং এর রচনাবলির নির্ধারিত পাঠ, বিদেশি ভাষা প্রকাশনালয়, পিকিং, ১৯৭১, পৃ. ২৭৮-২৮০]। মাওয়র কবিতার অধিকাংশই বিপ্লবকালীন যুদ্ধের ময়দানে রচিত। যার শব্দের গাঁথুনি অত্যন্ত ঋজু ও বলিষ্ঠ এবং বাক্যের গঠন আলোর স্ফুরণ ঘটায়। আর মাওয়ের কবিতার সবটাই চীনের সনাতন ধ্রুপদি ভাষারীতির সুর-ছন্দে রচিত। বিষয়বস্তুর মর্মমূলে রয়েছে স্বদেশ প্রেম, প্রকৃতি বন্দনা ও যুদ্ধ জয়ের বীরত্বের বিজয় কেতন। এবং এর মধ্যেই চীনের আবহমান ঐতিহ্য, রূপকথা, ধ্রুপদি লোকগীতির সুরের মূর্চ্ছনা ও মার্ধুয-যা এক রোমান্টিক স্বপ্নবিলাস ও বাস্তবতার সম্মিলন বই! এই গ্রন্থের কবিতাগুলো বাংলায় তর্জমা করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলা ভাষার সেরা কবিরা-যারা আজ সবই প্রয়াত।
কবি ও গবেষক মুস্তাফা মজিদ এর রয়েছে ১০টি কাব্যগ্রন্থ। যথাক্রমে- ‘মেঘবতী সুবর্ণভূমি, “তােকে নিয়ে প্রেম প্রেম খেলা, কুসুমিত পঞ্চদশী’, ‘পুষ্পপত্রে নীলকণ্ঠ’, ‘জনযুদ্ধের কনভয়, ‘সাকিন সুবিদখালী’, ‘স্বাতীর কাছে চিঠি’, Diary of a Nepalese Guerrillas সম্পাদিত কবিতাসমগ্র ঃ মাও সেতুঙ এবং নিবেদিত কবিতা সংকলন ‘প্রাণিত রবীন্দ্রনাথ’ । এই কবি কবিতা লেখার পাশাপাশি বাংলাদেশে বসবাসরত। মঙ্গোলীয় ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে লােক প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র নিয়েও গবেষণা করে আসছেন। বাংলাদেশের রাখাইন জাতিসত্তার আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক সমীক্ষা নিয়ে অভিসন্দর্ভ রচনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি ডিগ্রী অর্জন করেন। যা বাংলাদেশের রাখাইন’ শিরােনামে বাংলা ভাষায় বাংলা। একাডেমী এবং The Rakhaines শিরােনামে ইংরেজি ভাষায়। ঢাকার মাওলা ব্রাদার্স থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । ড. মুস্তাফা মজিদের এ পর্যন্ত রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ সংখ্যা। ৪০ উর্ধ্ব। তার উল্লেখযােগ্য গ্রন্থের মধ্যে ত্রিপুরা জাতি। পরিচয়’, ‘পটুয়াখালীর রাখাইন উপজাতি', আদিবাসী রাখাইন’, ‘মারমা জাতিসত্তা' বাংলাদেশে মঙ্গোলীয়। আদিবাসী’, ‘গারাে জাতিসত্তহজং জাতিসত্তা’, আদিবাসী সংস্কৃতি (১ম ও ২য় খণ্ড), রূপান্তরের দেশকাল’, ‘সমকালের আত্মকথন’, ‘লােক প্রশাসনের তাত্ত্বিক প্রসঙ্গ’, ‘বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র', 'রাজনীতিতে সামরিক আমলাতন্ত্র’, ‘নেতৃত্বের স্বরূপ’, বাংলাদেশে বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘মুক্ত ও মুগ্ধদৃষ্টির রবীন্দ্র বিতর্ক’ । আর ছােটদের জন্য রচিত ও সম্পাদিত গল্প গ্রন্থ। ‘দীপুর স্বপ্নের অরণি’, ‘জীবন থেকে’ ও ‘ছােটদের ৭টি মঞ্চ নাটক’ এবং জীবনী গ্রন্থ ‘রূপকথার নায়ক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন’ ও ‘বঙ্গবীর ওসমানী। মার্কসীয় মুক্ত চিন্তার যৌক্তিক দৃষ্টবাদে অবিচল মুস্তাফা মজিদ কৈশােরে উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে। অংশগ্রহণসহ কৈশাের থেকেই নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। জড়িত । বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য, জাতীয় কবিতা পরিষদ, ছায়ানট, ঢাকা থিয়েটার ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য। এছাড়াও তিনি সত্তর ও আশির দশকে শিশু-কিশাের। সংগঠন গড়া ও নাট্য আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন । পেশায় প্রথমে সাংবাদিকতা এবং পরে ১৯৮৪ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত আছেন। বর্তমানে মহাব্যবস্থাপক ড. মুস্তাফা মজিদ ১৯৫৫ সালের ১৪ই এপ্রিল পটুয়াখালী জেলার সুবিদখালীতে জন্মগ্রহণ করেন । ভ্রমণ করেছেন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইডেন, জার্মানী, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ড।