“এক মলাটে তিন নাটক” বইটি সম্পর্কে কিছু কথা: পারো, পারাপার, পেন্ডুলাম। এক মলাটে তিনটি নাটক হলেও ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের আশ্রয়ে তিনটি একদমই আলাদা ব্যাঞ্জনার নাটক। পারো নাটকে আমি কথা বলিয়েছি পারমিতা নামের এক নারীকে দিয়ে যার টানপোড়েনের দুই প্রতিপক্ষ সে নিজেই। দৃশ্যমান পারমিতা এবং পারমিতার অন্তঃপুরে বাস করা প্রাচীন বিশ্বাসের পারমিতা। সবকিছু নিয়ে তাদের বিরোধ। পারমিতা স্বামীর সাথে সংসারের পাঠ চুকিয়ে একা বাস করে। স্বামীর বিরুদ্ধে তার অভিযোগ স্বামী তাকে সবকিছু মেনে নিতে বলেছে। পারমিতার অফিসের বস পারমিতার কাঁধে আঁকা উল্কিতে একটা চুমু খেতে চেয়েছিলো বলে সে অফিস ছেড়ে চলে এসে স্বামীকে বলেছিলো বসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। স্বামী বলেছিলো চাকরি করতে গেলে এরকম একটু আধটু হয়। তাই পারমিতার বিকল্প ছিলো না স্বামীকে ছেড়ে আসার। এখন পারমিতার ভেতরের পারমিতা তাকে বারবার বলতে থাকে আপস করো পারমিতা। আপস করো। বাইরের পারমিতা অন্তঃপুরের পারমিতাকে সহ্য করতে পারে না। একদিন সে অদৃশ্য পারমিতাকে গলা টিপে হত্যা করে । পারাপারে গল্প চিনু সরদার বলে এক গায়েনের জীবনাশ্রয়ী। চিনু গায়েন জোসনা নামের এক গ্রাম্যবালাকে বিবাহ করে নিয়ে যাচ্ছে সীমান্তের ওপারে। অন্তরের গভীরে তার লুকানো উদ্দেশ্য জোসনাকে সে ওপারে নিয়ে কোনো গণিকালয়ে বিকোবে । কিন্তু সীমান্তের চোরাই পারাপারের স্থানে উপস্থিত হয়ে চিনু জানতে পারে কাশ্মীর সীমান্তে অস্থিতিশীলতার কারণে সব কিছু বন্ধ করে দিয়েছে। রাশু কোম্পানির চালাঘরে আশ্রয় হয় তার। হয় জোসনার সাথে বিবাহবাসর। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে সামনের ঘর থেকে যে নারী বেরিয়ে আসছে সে আর কেউ নয় তার প্রেমিকা মাঞ্জেলা। যাকে সে চারবছর আগে কথা দিয়ে এসেছে একটা ভালো চাকরি পেলে সে ফিরে এসে বিবাহ করবে তাকে। চুড়িবুড়ি নামে এক বৃদ্ধা তাকে ওপারে নিয়ে যাচ্ছে বিক্রি করবে বলে । একদিকে জোসনা, যাকে সে ওপারে নিয়ে যাচ্ছে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আর মাঞ্জেলাকে সে যেতে দেবে না। না জোসনা না মাঞ্জেলা কেউই জানে না এসবের কিছুই। শেষমেশ চিনু কাউকেই বাঁচাতে পারে না। পারাপার এক অনন্ত পারাপারের ভিতর দিয়ে শেষ হয় । পেন্ডুলাম নাটকের মূল চরিত্র নিঃসঙ্গতা। যেমন রতন পেন্ডুলামের একটা চরিত্র। নিঃসঙ্গতাও তাই। রতন ও নিঃসঙ্গতা পাশাপাশি বসবাস করে। রতন তার এই সহবাসীকে দেখতে পায়। নিঃসঙ্গতাও রতনকে দেখে। নিঃসঙ্গতার একটা নিজস্ব সত্ত্বা আছে। ক্রমে সে মানুষের অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। নিঃসঙ্গতা সময়কে প্রকট করে তোলে ব্যক্তির কাছে। সময় বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝুলে থাকে পেন্ডুলামের কিনারে। পেন্ডুলাম ভারী হয়ে ওঠে। পেন্ডুলাম নিয়ম ভাঙ্গতে পারে না বলে চলে কিন্তু পাশে বসে থাকা মানুষটাকে সঠিক সময় দেয় সে না। একবার তাকে কৈশোরে নিয়ে যায় । স্মৃতিকাতর করে তোলে । পরক্ষণেই ফিরে আসে আপন ঘরে । ঘরটাকে রতনের মোটেও আপন মনে হয় না। শরীরটাকে ঘরে রেখে রতন বেরিয়ে পড়ে অতীতের পথে । অনেক কিছুর ভেতরে থেকেও কোথাও থাকে না রতন । একটা বিরাট শূন্যতাবোধ তার পারিপার্শিকতাকেও শূন্য করে দেয়। চির আপন চেয়ারটাকে, পরবাসের সন্তানকে, ছেড়ে যাওয়া স্ত্রীকে তার চির শত্রু বলে মনে হয় । নিজের বেঁচে থাকাকে অনর্থক ভেবে আত্মনিপীড়নে সুখ অনুভব করে সে। তখন পরাজিত রতন বেঁচে থাকতে চায় পরাজয়ের শেষটুকু দেখার জন্যে। বয়স রতনের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। বয়সের বলিরেখা, সময়ের ধূলো/ কোন জলে ধোবে তুমি জীর্ণতাগুলো । পরাপার নাটকটা মঞ্চে এনেছে আমার দল দেশ নাটক। ঢাকা থিয়েটার ও দেশ নাটক-এর যৌথ প্রযোজনায় পেন্ডুলাম মঞ্চে আসবে। পারো মঞ্চে আনার প্রস্তুতি চলছে। দেশ নাটক-এর পঁচিশতম প্রযোজনা হিসাবে মঞ্চে আসবে পারো। তারও প্রস্তুতি চলছে। দেশ নাটকের সকল কর্মী ও কলাকুশলীর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এক মলাটে তিন নাটক আপনাদের সমীপে নিবেদন করলাম।
মাসুম রেজার জন্ম কুষ্টিয়ায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Applied Physics & Electronics-এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে কর্মক্ষেত্র হিসাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেছে নেন নাট্যচর্চা ও সাহিত্য। লেখা ও অভিনয় শুরু ছাত্র জীবন থেকে, বিশিষ্ট নাট্য সংগঠন বােধন-এর মাধ্যমে মঞ্চ ও টেলিভিশন নাট্যকার হিসাবে তুমুল জনপ্রিয় । বিরসাকাব্য, নিত্যপুরাণ, সুরগাও তার উল্লেখযােগ্য মঞ্চনাটক, শতাধিক টিভি নাটকের মধ্যে রয়েছে রঙের মানুষ, ভবেরহাট ইত্যাদি। মেরিল প্রথম আলাে সমালােচক পুরস্কার, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে তিনি।