ভেঙ্গে পড়ে, জেগে ওঠে ফিনিক্সের মতন, ক্রোধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে দুর্দান্ত জীবন বোধে। সৃষ্টির মহোৎসবে নিবেদিত এসব মহাত্মা কাল থেকে কালান্তরে নিক্ষেপ করে তাদের শব্দবর্ণবাক্য শর। কখনো কখনো তা অব্যর্থ লক্ষ্যভেদী নিশানায় মহাকালের দূরতম দৃশ্যপটে সৃষ্টি করে স্থায়ী চিহ্ন, কখনো তা মুখ থুবড়ে পড়ে যায় ধূসর ধুলোয়। সৃষ্টির ধর্মই তাই। সফলতা বিফলতার আশ্চর্য সুখ ও কষ্টের অনির্বচনীয় অনুভূতি অনুরঞ্জিত। কবিতার পৃথিবীর একঝাঁক জোনাকি মহসীন সৈকত, সায়লা বিলকিস, কাজী কনক সিদ্দিকা, গোলাম কুদ্দুস চঞ্চল, নিলোফার সুলতানা, সানজিদা এস কে, গালিব ইমতিয়াজ, সালমা পারভীন, ইফতে খারুল ইসলাম, দীপক কুমার সিকদার, শারমীন আকতার লাকী, ফিরোজা হক-রা তেমনি সৃষ্টিকর্মের স্রষ্টা। ‘একঝাঁক জোনাকির স্বপ্ন’ তাদের কবিতার প্রামাণ্য দলিল। আমি বিশ্বাস করি, ‘কবিতার পৃথিবী’ বাংলা কবিতার নতুন অভ্যুত্থানের এবং নতুন কবির অভ্যুদয়ের এক কাব্য আন্দোলন। তারই হাতিয়ার হিসেবে এই বারো কবির কবিতা সংকলন। ভবিষ্যতে আরও আরও কবির কবিতায় সমৃদ্ধ একাধিক কবিতা সংকলন কিম্বা কোনো কবির একক কবিতাগ্রন্থ প্রকাশেরও উদ্যোগ নেয়া হবে। সে কারণেই আমি কিছুটা সমালোচনা আকারেই এই লেখাটি লিখছি। সংকলনভুক্ত সব কবিরই রয়েছে কাব্যশক্তি, কাব্যপ্রতিভা। প্রকাশের ধরণ হয়তো একেক জনের একেক রকম। অপরিহার্য শব্দের অবিশ্যম্ভাবী বাণী-বিন্যাসকে’ যদি কবিতা বলা হয় তাহলে কবিতার শব্দ নিশ্চয়ই গদ্যের শব্দের চেয়ে ভিন্ন। কবির কাব্য প্রতিভার অন্যতম প্রধান ক্ষমতা তার শব্দচয়ন। আবার শুধুমাত্র কাব্যিক শব্দবুননে ঠাসা হলেও তা ঠিক কবিতা হয়ে উঠবে না। যদি না কবি পূরণ করেন কবিতার আরও কিছু অপরিহার্য শর্তাবলী। সবকিছুর একটা নিয়ম শৃঙ্খলা বা ব্যাকরণ থাকে যা কবিতার ক্ষেত্রেও অধিক প্রযোজ্য। কবিতায় অপরিহার্য শব্দাবলীকে রসঘন শিল্পমাত্রায় পৌঁছে দেয় বা উত্তীর্ণ করে ছন্দ-মাত্রা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প এবং কাব্যের অন্যান্য অনুসঙ্গ বা অলংকার। এই সংকলনের কবিদের কবিতায় সেসব কাব্যগুণ অবশ্যই রয়েছে তবে সবার সব কবিতায় কিম্বা একই কবিতার সর্বত্র তা রক্ষিত হয়নি। অধিকাংশ কবিতাই ব্যক্তিগত প্রেম-বিরহ, দুঃখ-বেদনা, আনন্দ-বিষাদ, সুখ-যন্ত্রণার ক্যানভাস। তবে কারও কারও কবিতায় দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা মানুষের মৌলিক অধিকারের কথাও উচ্চারিত হয়েছে। জনগণের শোষণ বঞ্চনা, দ্রোহ-প্রতিবাদের ভাষাও বাঙময় হয়ে উঠেছে। কবিতা যেকোনো বিষয় নিয়ে রচিত হতে পারে। তবে তাকে পরিপূর্ণ করতে হবে তার কাব্যশর্ত অর্থাৎ শিল্পমান। বিষয়, ভাব, ভাষা, শব্দ, ছন্দ, অলংকার সবকিছুর যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমেই একটি সার্থক কবিতার জন্ম হয়। এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত সব কবিরই কম বেশি প্রচেষ্টা আছে নিজ নিজ কবিতাকে শিল্পোত্তীর্ণ করে তুলতে। আমার অনুরোধ থাকবে সবাইকে, আরও বেশি অধ্যয়ন অনুশীলনের মাধ্যমে সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য। ‘কবিতার পৃথিবী’ সেজন্য মাঝে মাঝে কবিতার ক্লাস বা কবিতার আলোচনা, সেমিনার ইত্যাদির আয়োজন করতে পারে। পঠন-পাঠন-লিখন-অনুশীলন-পরিচর্চায় কবিতাকে অবিরত পরিশুদ্ধ সমৃদ্ধ এবং সর্বাধুনিক করে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প কবিতা। সেই স্পর্শকাতর অভূতপূর্ব অনুভূতির অতলে অবগাহন করেই পাঠকের হৃদয়গ্রাহী সৃজনশীলতার অপরূপ শব্দছবি তৈরি করাই কবির কাজ। কবিকে তাই নিয়ত কাব্যকুহকের আরাধনায় লিপ্ত থাকতেই হয়। কবির সৃজন বেদনা প্রসব বেদনার চেয়ে কম কিছু নয়। মহসীন সৈকত সম্পাদিত ‘একঝাঁক জোনাকির স্বপ্ন’ সেই জন্মযন্ত্রণার নাড়িছেঁড়া আর্তনাদ আর আনন্দ ধ্বনিতে দিকবিদিক মুখরিত করুক, আলোকিত করুক, স্বপ্নবান করে তুলুক নিজেদের এবং সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচারের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে। সেই কামনা করি।