হযরত শায়েখ ফরিদুদ্দীন আত্তার ১২’শ ২১ সালে মোঙ্গলদের হাতে নিহত হন। নিশাপুরে হামলার পর মোঙ্গলরা আরও অনেকের সাথে উনারেও কয়েদ করে নিয়া যাইতেছিল। পথে এক লোক তাদের বললো, এই আল্লার ওলিরে এই কবিরে মুক্ত কইরা দাও, তোমাদের জন্য এক হাজার দিনারের বন্দোবস্ত করতেছি।
কিন্তু আত্তার তাতারদের বললেন, এই দাম আমার উপযুক্ত না। এই কথায় তারা ভাবলো, হয়তো উনার দাম আরও বেশি। তো পায়ে শিকল দিয়া আত্তাররে নিয়া তারা আগায়তে থাকলো। কিছু সময় পর এক গরিব লোক আইসা মিনতি জানাইলো, উনারে তোমরা ছাইড়া দাও। বিনিময়ে আমি তোমাদের ওই যে খড়ের পালাটা দেখতেছ, পুরাটাই দিয়া দিবো। তার এই কথায় আত্তার তাতারদের বললেন, আমার দাম আসলে এর চাইতেও কম। তোমরা বিবেচনা কর কী করবা।
তখন হাজার আশরাফি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ক্ষোভে এক তাতার আত্তারের গলায় তলোয়ার চালায় দেয়। আর আত্তার মারা যান, এমন অবস্থায় যে, নিজের জীবনের জন্য তুচ্ছ দামটাও উনি নির্ধারণ করতে পারেন নাই।
তো এই আত্তার যখন কিছু লেখেন বা বলেন, শুধু উনি বেটার লেখক বইলাই যে তা উমদা হয়া উঠে, ব্যাপারটা অমন না। উনার বড় সামান হইলো রুহানিয়্যাত।
ভাষা পরবর্তনশীল হইলেও মানুষের আত্মার পুরান চাওয়া প্রায় একই। তাই হাজার বছর পরও উনি তর্জমা হন। একটা ভাষা থিকা আরেকটা ভাষায় আত্তার কই কই কতদূর মানুষের মনে চইলা যান।
আমি উনার মশহুর কিতাব ‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’র দুইটা অংশ – হযরত বায়েজিদ বোস্তামী আর রাবেয়া বসরীর জীবনীটুকু তরজমা করছি। রাবেয়া বসরীর ভূমিকায় তরজমার প্রাসঙ্গিকতা নিয়া দরকারি আলাপ করা হইছে। তাই এইখানে শুধু হযরত বায়েজিদ বিষয়ে সামান্য বলতেছি।
হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (১৩১-২৬১ হিজরী/৭৪৮-৮৭৪ ঈসায়ী) হইলেন সুফিদের সুফি। পুরা নাম আবু ইয়াজিদ তাইফুর ইবনে ঈসা ইবনে আদম সরুশান বোস্তামী। উপাধি সুলতানুল আরেফিন। হযরত বায়েজিদের জন্ম-মৃত্যু সাল নিয়া এখতেলাফ বা মতভেদ আছে। এছাড়া উনার জিন্দেগি নিয়া ধারাবাহিক কোনো বর্ণনা নাই। টুকরা টুকরা অংশ, যা সমসাময়িক এবং পরবর্তী সুফি ও কবিদের লেখায় আসছে, বেশিরভাগই উনার শাগরেদ আর ভক্তদের বয়ান। ফলে ইতিহাসের কোনো ভাঙা বা মসৃণ কাচ দিয়া এইগুলা বিবেচনার না। এইগুলা হইলো অনুভবের ব্যাপার।
হযরত বায়েজিদ বড় ঘরের সন্তান আছিলেন। উনার দাদা বিশাল কুমিস প্রদেশের গর্ভনর আর বড় দৌলতমন্দ ছিলেন। কিন্তু বায়েজিদের জন্ম হইছিল বোস্তামের সুফি মহল্লায়, তার বুজুর্গ বাপ তাইফুরের ঘরে। উনার মা-বা দুইজনেই ছিলেন খোদার দেওয়ানা। আলমে আরওয়াহ থিকা নিয়া আসা তাদের সন্তানও তাগো মতোন হইলো আর দুনিয়ার আবেগী হিস্ট্রিগুলার মধ্যে শীর্ষ হয়া থাকলো।
বাংলাদেশের চট্টগ্রামে হযরত বায়েজিদ বোস্তামীর (রহ.) নামে যেই দরগাহ বা মাজার আছে, এইরকম পৃথিবীর আরও অনেক দেশেই আছে। ভক্ত-আশেকানরা নানা সময়ে হযরতের নামে এই খানকাগুলা করছেন। তবে উনার আসল মাজারটা ইরানের বোস্তামে। বায়েজিদের কবরের মর্মর পাথরে হযরত আলীর (রাযি.) কবিতা লেইখা দিছেন কেউ। এইটা খুবই মিলছে। উনাদের দুইজনের ব্যক্তিত্ব আর বলাগুলার উৎস তো একই।
তাজকিরাতুল আউলিয়ার বাংলা অনুবাদ যা হইছে এ পর্যন্ত, ভালো তো না-ই, বরং আত্তারের লেখারে মাইরা ফেলছেন অনুবাদকরা। মূল থিকা তরজমা না হওয়ায় ওইসব অনুবাদ ভাসা ভাসা পানার মতোই কিছু লাগে যেন। তাই যখন ইমরুল ভাই তাজকিরাতুল আউলিয়ার দারুণ একটা ফার্সি এডিশন, যা কিনা ১৯০৫ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি বিভাগের অধ্যাপক রেইনল্ড এ. নিকলসনের সম্পাদনায় লন্ডন থিকা বের হইছে, জোগাড় কইরা দিলেন, কাজটায় হাত দিলাম আমি।
তো উনারে শুকরিয়া জানায়া খতম করলাম। আর শুকরিয়া, বইটা প্রকাশে যারা মন দিয়া মেহনত করছেন – সাদ্দু ভাই আর যুবা ভাই, উনাদেরও।