ইতালো ক্যালভিনো (১৯২৩-১৯৮৫) বাঙলাদেশে খুব পরিচিত বা জনপ্রিয় লেখক না। জনরা হিশাবে ফ্যান্টাশি, স্যুররিয়ালিজম, জাদুবাস্তবতা ইত্যাদি জিনিশ যতটুক মার্কেট পাইছে বাঙলাদেশে, তার বিচারেও ক্যালভিনোর মার্কেট খারাপ। অনলাইন ও অফলাইনে, বই সংক্রান্ত আলাপসালাপে ক্যালভিনোর নাম আমি আঙুলে গুইনা ম্যাক্সিমাম দশবারের বেশি শুনছি বইলা মনে পড়ে না। তার বইয়ের বাঙলা অনুবাদও খুব একটা যে হইছে, তেমন বলা যাবে না। এর কারণ কী? ফ্যান্টাশি বা ম্যাজিক রিয়ালিজমের কাটতি বঙ্গবাজারে একেবারে কম, তা কইলে গুনাহ হবে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তো বাজারে আছেন। আরো অনেকেই আছেন, নাম নিয়া ফ্যাসাদে পড়তে চাই না। তুলনায় ক্যালভিনোর পাঠক কম কেন, তার একটা উত্তর হইতে পারে— ক্যালভিনোর অনুবাদ বাঙলাভাষায় তেমন হয় নাই। এদেশে যেসব প্রতিষ্ঠান মানুশের, মোটাদাগে মধ্যবিত্তের পাঠরুচি তৈরি করেন, তাদের হটলিস্টেও ক্যালভিনো নাই মনে হয়। অন্তত, তার সময়ের অন্যান্য অনেকে যেইভাবে আছেন আরকি, সেইভাবে নাই। আমার মনে হয়, এর একটা মেজর কারণ হইতে পারে— ক্যালভিনো বড় কোন আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরষ্কার পান নাই। ‘ইনভিজিবল সিটিজ’র জন্য যে ইতালিয়ান পুরষ্কারটা উনি পাইছিলেন, সেই ‘প্রেমিও ফেলত্রিনেল্লে’ বাঙলাদেশে উল্লেখযোগ্য কোন অ্যাওয়ার্ড না। আরেকটা কারণ হইতে পারে, এনাফ লেখক ইমেজ তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হইতে না দেওয়া। উইকিপিডিয়ায় আপনি ‘ইতালো ক্যালভিনো’ লেইখা সার্চ দিলে, সার্চবারের নিচে অটো সাজেশনে তার উইকিপেজের যে টাইটেল আসবে, তার নিচে ছোট কইরা লেখা ‘জার্নালিস্ট’। মানে, জার্নালিস্টও তো লেখক হইতেই পারেন, কিন্তু হেমিংওয়ে, মুরাকামি বা মার্কেজের নাম সার্চ দিলে আপনি নামের তলে ‘রাইটার’ পরিচয়টা পাইবেন। তো, ইন্টারন্যাশনালি তারে জার্নালিস্ট হিশাবে পরিচয় করায়ে দেওয়ার যে উইকি-উদ্যোগ, এইটা আমার কাছে তার এনাফ লেখক-ইমেজের ঘাটতিই মনে হইলো, এর কারণ যাই থাকুক। এই দুইয়ের বাইরে, আরো আরো কারণ আছে নিশ্চয়ই। ক্যালভিনো কে, কোথায় জন্ম নিছেন, কী লিখছেন, কীভাবে লিখছেন— এইসব তথ্য এই বইয়ে ছাপা ইন্টারভিউর ভূমিকায় পাওয়া যাবে। গুগলেও পাবেন কিছু কিছু। এইখানে, অন্তত দুইটা তথ্য দেওয়া যাইতে পারে ওনার ব্যাপারে। এক. ক্যালভিনোরে একইসাথে, উনিশ ও বিশ শতকের দুইটা উল্লেখযোগ্য ও কিছুটা পরস্পরবিরোধী লিটারারি মুভমেন্ট— নিও রিয়ালিজম (নয়া বাস্তববাদ) ও ম্যাজিক রিয়ালিজম (জাদুবাস্তব)-এর অন্যতম প্রধান রাইটার মনে করা হয়। ১৯৮৫ সালে উনি মরার পরে লস এঞ্জেলেস টাইমসের শিরোনাম ছিলো— ‘ব্যাপকভাবে প্রশংসিত নব্যবাস্তববাদী, অথচ উদ্ভট উদ্ভট ক্যারেক্টারের জন্য বিখ্যাত ইতালিয়ান উপন্যাসিক ইতালো ক্যালভিনো মারা গেছেন।’ দুই. ক্যালভিনো ইতালির এন্টি ফ্যাশিস্ট সার্কেলের প্রভাবে, পঞ্চাশের দশকে ইতালিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দিছিলেন। তার প্রথম বই, ‘দ্য পাথ টু দ্য স্পাইডার্স নেস্ট’ হিট হইলেও, পরের বই, ‘দ্য ক্লোভেন ভাইকাউন্ট’র ‘আন রিয়ালিস্টিক অ্যাপ্রোচ’ নিয়া পার্টির তরফে বেশ কড়া সমালোচনা আসে। রাশিয়ার হাঙ্গেরি আক্রমণের পরে, ক্যালভিনো পার্টি ছাইড়া দেন।
কিউবায় জন্ম ইতালাে কালভিনাের, ১৯২৩ সালের ১৫ই অক্টোবর। মেক্সিকোর বিপ্লবের অল্প কিছুদিন পর তাঁর পরিবার ইতালিতে ফিরে আসে এবং সান। রেমােতে থিতু হয়; সেখানেই জীবনের প্রথম বিশ বছর কাটে তার। মূলত তিনি ত্রিবিধ পরিচয়ের অধিকারী: কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক এবং সাংবাদিক। Le Citta Invisibili নামে ইতালীয় ভাষায় প্রকাশিত (১৯৭২) এবং উইলিয়াম উইভার কর্তৃক ইনভিবিল সিটি নামে ইংরেজিতে অনুদিত (১৯৭৪) বইটি তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম বলে বিবেচিত, অধিকাংশ পাঠক ও সমালােচকের কাছে। একই সঙ্গে নব্যবাস্তববাদী এবং জাদুবাস্তবধর্মী সাহিত্যের স্রষ্টা কালভিননার অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে উপন্যাস দ্য পাথ টু দ্য নেস্ট অভ স্পাইডার্স, দ্য ব্যারন ইন দ্য ট্রিয, দ্য নন-এক্সিসটেন্ট নাইট, দ্য ক্লোন ভাইকাউন্ট, দ্য ক্যাসল অভ ক্রসড় ডেসটিনি, ইফ অন আ উইন্টার্স নাইট আ ট্রাভেলার, গল্পসংগ্রহ ডিফিকাল্ট লাভ, প্রবন্ধসংগ্রহ লিটুরেচার মেশিন, এবং ইতালীয় লােকগল্পের সংকলন ইটালিয়ান ফোকটেলস। ১৯৮৫ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর রােমে বাষট্টি বছর বয়সে মৃত্যু হয় তার।