ভূমিকা। প্রবাস পটভূমিতে লেখা বারোটি ভিন্নধর্মী গল্প দিয়ে সাজানো সংকলন "বহতা"। বাংলাদেশ সরকারের হিসাব মতে প্রায় এক কোটি তিরিশ লক্ষ অভিবাসী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যদিও বাস্তবে এর সংখ্যা আরো অনেক বেশি। অভিবাসীদের সুখ দুঃখ বা হাসি কান্নার গল্প কিন্তু আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। "বহতা" সংকলনটি বাস্তবতার কাছাকাছি রেখে প্রবাসীদের জীবনে ঘটে যাওয়া নানান কাহিনীর সাত কাহন। আমি নিজে প্রবাসী, প্রায় দু দশক আগে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাই উন্নত শিক্ষা ও জীবনের হাতছানিতে। একটা সময় পর এ দেশে স্হায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে পাকাপাকিভাবে থিতুও হয়ে গেলাম। এরই মধ্যে পেশাগত বা ভ্রমণের নেশায় তিরিশটিরও বেশি দেশ দেখা হয়ে গেছে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের জীবন খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে বলেই হয়তো আমার অনেক লেখার পটভূমি প্রবাস নির্ভর। এ কথা সত্য, প্রথম প্রজন্মের মাইগ্র্যান্টদের নানারকম প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা পেতে হয়। আবার অস্হায়ী ভিসায় বিদেশে যাওয়া যেমন স্টুডেন্ট বা ওয়ার্কারদের অনেকেরই প্রবাসে স্হায়ী হওয়ার সুযোগ থাকে না। তাইতো বিদেশে একেকজনের সংগ্রাম একেক রকম, প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব গল্প। কিছু গল্প আশা জাগানিয়া আবার কিছু গল্প সত্যই হতাশার। ভিন দেশে ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের বাধা পেরিয়ে অভিবাসীদের টিকে থাকার চেষ্টা ও সংগ্রামের গল্পের সমাহার এই "বহতা"। সেই সাথে সামাজিক বা অর্থনৈতিক কষ্ট সহ মাইগ্র্যান্টদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়গুলোও অনেক গল্পে উঠে এসেছে। মূলত অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী জীবনের কাহিনী নিয়ে সাজানো এই গল্প সংকলন নিশ্চিতভাবেই আপনাকে অভিবাসী জীবন সম্পর্কে সম্যক ধারনা দিবে। "বহতা" সংকলনটির প্রথম গল্পের নাম "বহতা"। সাবিনা নামক এক তরুণীর ঘটনাবহুল জীবনের আখ্যান। মেয়েটির জন্ম ঢাকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। উচ্চশিক্ষিত পরিবারের উচ্চশিক্ষিতা এই মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়ন কালীন সময় ভুল মানুষের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে ব্রেকআপ ও অন্য পুরুষের সাথে বিয়েটাতেও সুখী হতে পারেনি। ডিভোর্সী সাবিনা দেশে একপ্রকার টিকতে না পেরে অস্ট্রেলিয়ায় স্টুডেন্ট হিসেবে চলে আসে। এরপর অস্ট্রেলিয়ায় স্হায়ীভাবে টিকে থাকার চেষ্টায় অস্ট্রেলিয়ান এক লোককে বিয়ে করা, যা আবারো বিচ্ছেদে গড়ায়। এরপর অনেকদিন একা থাকা এই মেয়েটার জীবনে এক সময় সত্যিকারের সঙ্গীর দেখা মেলে। সাবিনার পুনঃবিয়ে করে সংসারী হওয়ার মাধ্যমে ইতি টানা এই গল্পটি নিঃসন্দেহে আপনার মনে দাগ কেটে যাবে। দ্বিতীয় গল্প "অবশেষে", মোনা নামের এক অল্প বয়সী তরুণীর প্রবাসে চালিয়ে যাওয়া প্রতিনিয়ত সংগ্রামের করুন কাহিনী। মোনা সিডনিতে স্টুডেন্ট ভিসায় আসা এক ছাত্রের স্ত্রী, যে কি না স্বামীর খরচের যোগান দিতে গিয়ে দিনের পর দিন অমানবিক পরিশ্রম করে গেছে। স্বামী ফয়সালের বিরুদ্ধে এক সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করে সংসার থেকে সরে আসার সাহসী সিদ্ধান্তের উপাখ্যান এই "অবশেষে"। তৃতীয় গল্প "অথৈ" প্রবাসে এক অকাল বিধবার ঘুরে দাড়ানোর প্রেরণাধর্মী লেখা। আর "প্রত্যয়" অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশে থেকে পাশ করে আসা মাইগ্র্যান্ট ডাক্তারদের প্রথম দিকের সংগ্রামের গল্প। প্রবাসী ডাক্তাররা যে শেষ পর্যন্ত প্রতিকুলতা ঠেলে এই দেশে ভালো অবস্হান করে নেয়, তা এই আশাবাদী গল্পে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। প্রবাসে আসা অল্প বয়সীদের অনেকেই নিজেদেরকে ধরে রাখতে পারে না, বেহেসিবী জীবনে গা ভাসিয়ে দেয়। এর ফলে অনেক সময় বাংলাদেশ থেকেও অভিভাবকদের টাকা পাঠাতে হয়, তাদের বিলাসী জীবনের চাহিদা মেটাতে। কিন্তু পরবর্তীতে অনেকে ছেলে মেয়েরাই এই ভুল থেকে সরে আসে, পরিবারের প্রতি থাকা "দ্বায়িত্ববোধ" উপলব্ধিতে। পরের গল্প "বিপদ" খানিকটা রম্যধর্মী, এক মেলবোর্ন প্রবাসীর বিয়ে শেষে স্ত্রী সহ দেশে ফেরার পথে হঠাৎ করেই প্রাক্তনের সাথে দেখা হওয়া। এরপরএয়ারপোর্ট ও প্লেনে মজার মজার ঘটনা নিয়ে লেখা এই গল্পটি নিশ্চিতভাবেই আপনাকে আনন্দ দিবে। বুয়েট থেকে পাশ করা শিবলী ভাইয়ের অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে মাইগ্রেশন, পরিবার চালাতে গিয়ে ট্যাক্সি চালনা পেশায় জড়িয়ে যাওয়া। আর একটানা পঁচিশ বছর ট্যাক্সি চালাতে গিয়ে পরবর্তীতে স্ত্রী বাচ্চাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কষ্টের উপাখ্যান "স্যাক্রিফাইস"। আর "প্রবাসী পাত্র" গল্পে প্রবাসে থাকা ছেলে বা কনেদের সম্পর্কে বায়োডাটায় দেওয়া তথ্য ফাঁদের বিষয়টির উপর নির্ভর করে লেখা। বিদেশে থাকা পাত্র পাত্রীদের কাছে সন্তানের বিয়ে দেওয়ার আগে তথ্য যাচাই বাছাই যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তা রম্যের মাধ্যমে বর্নণা করা হয়েছে। বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যদের বেড়ে উঠার সময়টা যে কতোটা চ্যালেঞ্জিং তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সঠিকভাবে বাচ্চাদের শিক্ষা না দিলে সহজেই ভুল পথে চলে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। আর সর্বোপরি দ্বিতীয় প্রজন্মের বিয়ে নিয়ে নানা রকম জটিলতার শিকার হওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে "প্রবাস কনে" গল্পটিতে। "মেয়ে" গল্পটি বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এক তরুণীর সারাজীবন অবহেলার শিকার হওয়ার এক আখ্যান। প্রথমজীবনে নিজ পরিবারে অ্যাবিউজড হওয়া আর বিয়ের পর স্বামীর কাছ থেকে অসহযোগিতা আর অবহেলা, মেয়েটাকে শেষ পযর্ন্ত তিন বাচ্চা নিয়ে আলাদা হতে বাধ্য করে। এরপর বিদেশের মাটিতে নিজের পায়ে নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন ফুটে এসেছে এই গল্পটাতে। "বন্ধুত্ব" এই গল্প সংকলনের এগারোতম গল্প। যেটিতে সলিম নামের এক অটোরিকশা চালকের সততার কাহিনী খুব প্রাঞ্জল ভাষায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এক প্রবাসী অধ্যাপকের হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ফিরিয়ে দেওয়ায়, অধ্যাপকের সাথে সলিমের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। আপাত দৃষ্টিতে অসম বন্ধুত্ব মনে হলেও এদের সম্পর্ক সত্যই আন্তরিকতাপৃর্ণ। আর সংকলনের সবচাইতে শেষের গল্প "মায়ের রোজা" নিশ্চিতভাবেই আপনাকে সিক্ত করবে। এক অকাল বিধবার চার সন্তান নিয়ে সংগ্রামী জীবন, পরবর্তীতে ছেলেমেয়েদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ারএই গল্পটি ভীষণ আশা জাগানিয়া। গল্পের ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য বিনীত অনুরোধ রইলো। সব গুলো গল্পের স্হান, কাল বা চরিত্র কাল্পনিক। যথাসম্ভব সহজবোধ্য প্রাঞ্জল ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি। আশা করি "বহতা" আপনাদের ভালোবাসায় সিক্ত হবে ও পরবর্তী লেখার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।