জন্মের ১৪ বছর ১১ মাস ৩৬৫ দিনের দিন আমার আর ওর দেখা হলো। সেই আমাদের প্রথম দেখা। তখন দুপুরের তীব্র রোদ ঝকঝকে শানানো ছুরি হয়ে নেমে আসছে এ শহরের অলিগলিতে, রাজপথে, ফুটপাতে, বাড়ির বারান্দা ও ছাদে। আইল্যান্ড ও রাস্তার পাশে, দরদালানের ফাঁকফোকড়ে গজিয়ে ওঠা গাছগুলো তাদের ফ্যাকাশে মরো মরো সবুজ পাতা মেলে ধরে আছে খুন হয়ে যাওয়ার তীব্র নেশা নিয়ে। কিন্তু খুনোখুনির কোনো তাড়া নেই সে রোদের তীক্ষ্ণ ডগায়, কী এক উন্মাদনায় সে কেবল তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে শহরের বাড়ি-ঘর-রাস্তার প্রতিটি বিন্দুকে। আমাকেই কি খুঁজে বেড়াচ্ছে সে? না কি আমার মতোই আর কাউকে? আহ্, কাকে যে খুঁজছে সে- কাকে যে খুঁজছে নিঃসঙ্গ দুপুরের ওই রোদ! যদি সে আমাকেই খুঁজে থাকে, খুঁজে কি পাবে ফ্যাকাশে সবুজ পাতার ভাঁজে? না কি খুঁজে পাবে পাতার নিচে স্থির হয়ে থাকা ছায়া পাতার স্তব্ধতাতে? আমি তো তখন ঘরের ভেতর। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, একটু আগেই তিন মগ পানি ছিটিয়ে দিয়েছি ঘর আর জানালার সব ক'টি পর্দায় যাতে গরম বাতাস আর ঘুরপাক খেতে না পারে ঘরের ভেতর। তারপর টান হয়ে শুয়ে পড়েছি শূন্য মেঝের ওপর মাথার নিচে শুধু একটা বালিশ নিয়ে। রোদ- রোদ তবু সবখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে! আমাকেই কি হন্যে হয়ে খুঁজে খুঁজে অপেক্ষা করছে অবশেষে এইভাবে? কোনও একদিন আমিও কি চেয়েছি ওরই মতো রোদ হয়ে অপেক্ষা করতে? অমলকান্তির মতো ছাপাখানার অন্ধকারে বসেও কি এখনও চাই জাম-জামরুলের পাতায় অল্প-একটু হাসির মতো রোদ্দুর হয়ে যেতে? মনে নেই, মনে পড়ে না, আমার আর কোনও কিছু মনে পড়ে না। বিস্মৃতির মধ্যে আমি ডুবতে থাকি, রোদ্দুর হয়ে যেতে থাকি, রোদ্দুরের ভাই রোদ্দুর খুঁজে বেড়ায় রোদ্দুরকে। কী আকুলতা তার উত্তাপে উত্তাপে! আমি তবু ডুবে যেতে থাকি বিস্মৃতিময় অতলে। ঠিক তখনই কেউ কড়া নাড়ে- এরকম সময়ে ফকির আর ফেরিওয়ালা ছাড়া কেউ আসে না। যদিবা কেউ আসে, কড়া নাড়ে আস্তে আস্তে বিরতি দিয়ে। কিন্তু ফকির আর ফেরিওয়ালারা এসবের ধার ধারে না। কড়া নাড়তে নাড়তে তারা হিংস্রতা ঝরিয়ে চলে, মাঝে মাঝে আবার হাঁকও ছাড়তে থাকে। কিন্তু এখন হাঁকাহাঁকি না করে বোধহয় খানিকটা দুর্বল চিত্তে কড়া নেড়ে চলেছে। ফকির ভেবে আমি তাই আগের মতোই চোখ বুজে শুয়ে থাকি মেঝের ওপর। এরপর বেল বাজে। আমি চিৎকার করে বলি, মাফ করো, খুচরা টাকা নাই। হয়তো আমার কথাগুলো কেউ মন দিয়ে শুনল, অথবা শুনল না। আবারো বিকট শব্দে কলিং বেল বেজে চলল। এবার আমি ক্ষিপ্রপায়ে উঠে গিয়ে 'বললাম না, মাফ করো? খুচরা টাকা নাই?' বলতে বলতে দরোজা খুলেই থতমত খেয়ে গেলাম। আমার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি খুব নির্লিপ্ত গলায় বলল, আমি অদিতা । এইভাবে জন্মের ১৪ বছর ১১ মাস ৩৬৫ দিনের দিন দেখা হলো আমাদের। আমাদের মানে আমার আর আমার অবৈধ কন্যার।
জন্ম : ১৩৭১ বঙ্গাব্দ, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ ; সিরাজগঞ্জের সলপ জনপদের রামগাঁতী গ্রামে। মা : হামিদা সুলতানা। বাবা : চৌধুরী ওসমান। পেশা : সাংবাদিকতা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা : এমএসএস [সমাজ বিজ্ঞান]; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ : ডানাকাটা হিমের ভেতর (উপন্যাস, ১৯৯৬)। অন্যান্য উপন্যাস : আমরা হেঁটেছি যারা, চরসংবেগ, অন্ধ মেয়েটি জ্যোৎস্না দেখার পর, মোল্লাপ্রজাতন্ত্রী পবনকুটির, তা হলে বৃষ্টিদিন তা হলে ১৪ জুলাই, আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক, মৃত্যুগন্ধী বিকেলে সুশীল সঙ্গীতানুষ্ঠান, নীল কৃষ্ণচূড়ার জন্মদিনে, শাদা আগুনের চিতা, অন্তর্গত কুয়াশায়, যারা স্বপ্ন দেখেছিল। স্বীকৃতি : ‘মৃত্যুগন্ধী বিকেলে সুশীল সংগীতানুষ্ঠান’ গ্রন্থের জন্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কথাসাহিত্য পুরস্কার (২০১২), লোক সাহিত্য পুরস্কার (২০১৩), জীবনানন্দ সাহিত্য পুরস্কার (২০১৪), ‘শীতের জ্যোৎস্নাজাবলা বৃষ্টিরাতে’ গ্রন্থের জন্যে প্রথম আলো বর্ষসেরা সৃজনশীল গ্রন্থ পুরস্কার (১৪২১), কিশোর উপন্যাস ‘পাতার বাঁশি বাজে’র জন্যে শিশু একাডেমি পুরস্কার (১৪২১) এবং কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০২০)।