মানবসভ্যতা আজ ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সংকটের মুখোমুখি। সংকটকালীন সময়কালকে সংজ্ঞায়িত করতে আলেম, চিন্তাবিদ ও দার্শনিকগণ-সহ সকলেই হিমশিম খাচ্ছে। অন্যদিকে পৃথিবীর সকল ব্যবস্থা দ্রুত পরিবর্তন হওয়ার মাধ্যমে সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে চলেছে। নিঃসন্দেহে পরিবর্তনের এই গতি পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সংকট সমাধানের চিন্তা ও পথ সময়ের আলোকে গতিশীলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহর বর্তমান যে ভয়াবহ সংকট সেটিকে মোকাবিলা করার জন্য যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত কর্মপন্থা উদ্ভাবন করার পর্যাপ্ত প্রচেষ্টা হয়নি বললেই চলে। যারাও সংকটের মূলে প্রবেশ করে যুগের আলোকে সমাধান পেশ করেছেন তারা রয়ে গিয়েছেন আলাপের অগোচরে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মানবতা যখনই কোনো সংকটে নিপতিত হতো সেখান থেকে উত্তোরণের পথ বাতলে দিতেন হাকীকত অন্বেষী মুজতাহিদ আলেম, দার্শনিকগণ। আর সেই পথে সংকট সমাধান করত সেসময়ের সংগ্রামী নেতৃত্ব। তাই নেতৃত্ব ও শাসন ব্যবস্থা ছিল জ্ঞান কেন্দ্রিক বা হাকীকতের প্রতি মুখাপেক্ষী। কিন্তু ইসলামী সভ্যতার পতন (সাময়িক) পরবর্তী বর্তমান ক্ষমতাসীন পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিত্তি হচ্ছে শক্তি কেন্দ্রিক (চড়বিৎ ঈবহঃৎরপ)। যেখানে হাকীকত অন্বেষী জ্ঞান উপেক্ষিত। আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, ইতিহাসের বয়ান, রাজনৈতিক ধারা সবই এই পাশ্চাত্যের মুখাপেক্ষী! ফলশ্রুতিতে সত্যিকারের সমাধান ও মৌলিক কাজ গতানুগতিক পন্থায় উঠে আসা অনেকটাই অসম্ভব। তাই ইসলামী সভ্যতার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব, যুগের সমন্বয়ে ‘জ্ঞানের ধারাবাহিতা ও উদ্ভাবন’ আজ অনুপস্থিত। কারণ জ্ঞান মৃত্যুবরণ করেছে। কেননা, এই জ্ঞানের ধারা যুগজিজ্ঞাসার জবাব ও সভ্যতার বিজয়ে সঠিক রূপরেখা তুলে ধরতে পারছে না। তাই মিহওয়ারের লক্ষ্য-“জ্ঞানের পুনর্জাগরণের আন্দোলনকে মানুষের নিকট যৌক্তিকভাবে তুলে ধরার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। ইসলামী চিন্তা ও দর্শন এবং যুগজিজ্ঞাসার জবাবকে ইসলামের আলোকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের নিকট তুলে ধরে প্রতিটি চিন্তাকে তার নিজস্ব কক্ষপথে ফিরিয়ে আনা।” পথচলার অংশ হিসেবে “ত্রৈমাসিক মিহওয়ার” দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশ হলো। নতুন দুনিয়ার আলোকে কোরআনের ১৫০০ বছর পূর্তীতে আমাদের বাংলা অঞ্চল থেকেই নতুন ইশতেহার উন্মোচিত হবে সে প্রত্যাশা নিয়েই এবারের সংখ্যায় মূল প্রবন্ধ হিসেবে থাকছে জ্ঞানস¤্রাট আলিয়া ইজ্জজেতবেগভিচের ঐতিহাসিক প্রবন্ধ ‘আল-কোরআনের ১৪০০ বছর পূর্তীতে তাফাক্কুর’। বর্তমান সময়ে নারীর মর্যাদা ও নানাবিধ বিতর্কের সঠিক দিশামূলক লেখনী, শহীদ ড. লামিয়া ফারুকীর গবেষণাপ্রবন্ধ থাকছে বিশেষ প্রবন্ধ হিসেবে। উপমহাদেশীয় জ্ঞানের ধারাকে নতুনভাবে পরিচয় করাতে, এ সংখ্যায় অনূদিত হয়েছে প্রখ্যাত উসূলবিদ ও মুতাফাক্কির প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজের লেখনী। অর্থনীতিতে লিখেছেন প্রখ্যাত চিন্তাবিদ শাহ আব্দুল হান্নান, ফিলোসফি অফ সাইন্সের ক্ষেত্রে প্রফেসর ড. মেহদি গুলশানীর লেখাসহ থাকছে মাহফুজ আলমের সিনেমা দর্শন নিয়ে বিশেষ প্রবন্ধ। ইঞ্জিনিয়ার আশিকুর রহমান, শ্রদ্ধেয় শেখ নজরুল, মুহসিনা বিনতে মুসলিম ও হিশাম আল নোমান-সহ লিখেছেন অনেকেই। মূলপ্রবন্ধ অনুবাদ করেছেন বুরহান উদ্দিন। এছাড়াও অনুবাদ করেছেন তরুণ চিন্তক সায়েম মুহাইমিন, ইবনে আজাদ এবং মিহওয়ারের সহ-সম্পাদক ফজলে এলাহী। এ সংখ্যায় নতুন করে চারটি বিষয় যুক্ত করেছি, উসূল, সিনেমা, ফিলোসফি অফ সায়েন্স ও বই পর্যালোচনা। প্রতিটি বিষয়ই যুবমননে নতুন চিন্তার সংযোজন করবে বলে আশা রাখছি। মহান রবের নিকট আমাদের চাওয়া, জ্ঞানের অসীম আন্দোলনে আমাদের প্রচেষ্টা যেন সামান্যতম হলেও অবদান রাখতে সক্ষম হয়। আমীন।
হাসান আল ফিরদাউস জন্ম : বাংলাদেশের টাংগাইল জেলায়। তিনি সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি 'ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের' ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন এবং ত্রৈমাসিক মিহওয়ারের সম্পাদক।