গজেন্দ্র কুমার মিত্র রচনাবলী-৪ উপক্রমণিকা উপক্রমণিকা নিভার চিঠি পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অথচ মন খারাপ হবার কথা নয়। খুশী না হোক, নিশ্চিন্ত হবার কথা। আর, যার সম্বন্ধে উদ্বেগ আছে—তার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়া মানেই তো খুশী হওয়া। তবু কে জানে কেন, , মনটা অনেকক্ষণ ধরেই কেমন ভার-ভার হয়ে রইল, কোথায় যেন একটা বেদনাবোধ খচখচ করতে লাগল—অকারণেই। হেমন্ত মার মৃত্যুতে শোক করার কোন কারণ নেই, শোক করবার মতো কেউ বেঁচেও নেই আর—আমি তো পরস্যাপি পর তত্রাচ, কেন জানি না, চিঠিখানা পাবার পর থেকে কী একটা বিষণ্ণতা পেয়ে বসল আমাকে। আর সেটা, ক'দিন ধরে, অসংখ্য কাজের মধ্যে, সহস্র কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে বার বারই অনুভব করতে লাগলুম। খুব ছোট্ট মাছের কাঁটা গলায় বিঁধে থাকলে যেমন একটু বেদনা-বোধ হয়—তেমনিই। তাতে কাজ আটকায় না, তার জন্যে ব্যস্ত হতে হয় না, তবু একটু খচখচানি, একটু অস্বস্তি-বোধ হতেই থাকে। হঠাৎই মনে পড়ে গিয়েছিল কথাটা। অনেকদিন কোন খবর পাই নি। মানে নিই নি। হেমন্ত মা কেমন আছেন কে জানে, এখনও কি বেঁচে আছেন? এতদিনও? বেঁচে থাকা মানে আরও দুর্গতি, কিন্তু বুড়ির যা কপাল—অত সহজে কি মরবে? নিভাদের কাছে ছিলেন এটা জানি। অন্তত শেষ যা খবর পেয়েছি। নিভাদের ঠিকানা একবার দিয়েও ছিলেন আমাকে—সে-ই শেষ চিঠি তাঁর—অবশ্যই সেটা যত্ন করে রাখি নি। আছে কোথাও, তবে কোথায় তা মনে পড়ল না অনেক ভেবেও। নিতান্ত আন্দাজে আন্দাজেই একটা চিঠি দিয়েছিলুম। দৈবক্রমে সেটা ওদের কাছে পৌঁচেছে। তারই জবাবে খবরটা দিয়েছে নিভা। হেমন্ত মা মারা গেছেন—গত ডিসেম্বরে। ১৯৬৬-র ডিসেম্বর। বুড়ো শরীর, এবারের শীতের ধাক্কাটা আর সামলাতে পারলেন না। মাত্র তিন-চারদিনের জ্বরেই সব শেষ হয়ে গেল। তবে—সত্যি সত্যিই যে এত টপ করে মারা যাবেন উনি—ওরা বুঝতে পারে নি, তাই কোন খবর দেবার চেষ্টা করে নি। দিলেও অবশ্য লাভ হত না। অকারণে ব্যস্ত হওয়া ও ব্যস্ত করা সার হত। তার পরও, নানা কারণে বিব্রত ছিল বলে মৃত্যু-সংবাদটাও দিতে পারে নি। আমি যেন কিছু মনে না করি। ইত্যাদি— মনে করার কিছু নেই। নিভা ওঁর ভাইঝি—কিন্তু সে খুব নিকট সম্পর্ক নয়। নিভার বাবা হেমন্ত মার পিসতুতো ভাই হতেন, তাও আপন কিনা সন্দেহ। সে তুলনায় ওরা যা করেছে— ঢের করেছে। এতখানি ঝক্কি নিকট-আত্মীয়রাও নেয় না। শেষের দিকে অথর্ব নয়, একেবারে অশক্তই হয়ে পড়েছিলেন। ঘরের বাইরে যেতে পারতেন না, প্রাকৃতিক-কৃত্যও ঘরের মধ্যে নর্দমার ধারে সারতে হত। নির্ভার অবস্থাও এমন ভাল নয় যে, একটা আলাদা ঝি-চাকর রেখে দেবে ওঁর জন্যে। যা কিছু করতে হয়েছে নিজেদেরই। সাধারণ গৃহস্থ ঘরে বিয়ে হয়েছিল নির্ভার, কুষ্ঠিয়ার কাছে এক গ্রামে। ওরই মধ্যে একটু সচ্ছল সংসার ছিল ওদের। তবে সে সবই জমিজমার আয়ের ওপর নির্ভর। অর্থাৎ চাষী-গৃহস্থ ঘর—নগদ টাকা-পয়সা খুব বিশেষ ছিল না, তাই স্বাধীনতার পরও বছর-দুই সেখানেই পড়ে ছিলেন ওর স্বামী-শাশুড়ি। কে তাঁদের বুঝিয়েছিল যে, নদীয়ার ঐ অংশটুকু এধারের সঙ্গে জুড়ে দেবে। ফলে যখন চলে আসতে হল তখন কিছুই প্রায় নিয়ে আসতে পারলেন না। ব্রাহ্মণের ঘর—গুরুবংশ, বাসনকোসনই ছিল নাকি দু' সিন্দুক বোঝাই। তবু, শেষ মুহূর্তে এই জমি বদলের ব্যবস্থাটা হয়ে গিয়েছিল তাই রক্ষে। যা ফেলে এসেছেন তার তুলনায় অনেক কম, গ্রাসাচ্ছাদনটা চলে যাচ্ছে, এই পর্যন্ত। বাড়িও একটা পেয়েছেন, পাকাবাড়িই
গজেন্দ্রকুমার মিত্র (জন্ম: ১১ নভেম্বর - মৃত্যু: ১৬ অক্টোবর ১৯৯৪) তার জন্ম ১১ই নভেম্বর কলকাতা শহরে। বাল্যশিক্ষা শুরু হয় কাশীর এংলো-বেঙ্গলী স্কুলে। কলকাতায় ফিরে এসে ঢাকুরিয়া অঞ্চলে গজেন্দ্রকুমার বসবাস শুরু করেন এবং বালিগঞ্জ জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। স্কুল জীবন অতিক্রম করে অতঃপর তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে বই এর ব্যবসায় যোগ দেন ও ১৯৪০ সাল পর্যন্ত্য বই বিক্রি করেছেন গজেন্দ্রকুমার। স্কুল শিক্ষা সমাপ্তির কিছু পরেই বন্ধু সুমথনাথের সঙ্গে মাসিক সাহিত্যিক পত্রিকা 'কথাসাহিত্য' শুরু করেন| ১৯৩৬ সালে তৈরি হয় মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনা সংস্থা। গজেন্দ্রকুমারের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'মনে ছিল আশা', গল্পগ্রন্থ 'স্ত্রিয়াশ্চরিত্রম' | ১৯৫৯ সালে তাঁর 'কলকাতার কাছেই' উপন্যাস আকাদেমি পুরুস্কারে সম্মানিত হয়| 'কলকাতার কাছেই', 'উপকন্ঠে', 'পৌষ-ফাগুনের পালা'-এই ট্রিলজিকে (ত্রয়ী উপন্যাস) আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য উপন্যাস বলে গণ্য করা হয়| পৌষ-ফাগুনের পালা ১৯৬৪ সালে রবীন্দ্র পুরুস্কার পায়| গজেন্দ্রকুমারের লেখনীর বিচরনক্ষেত্র বিরাট ও ব্যাপক, সামাজিক উপন্যাস, পৌরানিক উপন্যাস, ঐতিহাসিক উপন্যাস, ছোট গল্প.কিশোর সাহিত্য-সর্বত্র তাঁর অবাধ গত| সুদীর্ঘ ষাট বছরের অধিককাল ধরে তাঁর কয়েক হাজার ছোটগল্প ও পঞ্চাশটিরও বেশি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে| তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক, প্রকাশক ও অনুবাদক।