গজেন্দ্র কুমার মিত্র রচনাবলী-২ প্রথম পরিচ্ছেদ সেবার আশ্বিনের প্রথম থেকেই মহাশ্বেতার শরীরে একটা কি গণ্ডগোল দেখা দিল। দিনরাতই গা-বমি-বমি করে, কেমন যেন ঢিশ্ ঢিশ্ করে শরীর—কিছুই ভাল লাগে না। কেবল শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। দিনকতক এইভাবে যেতে যেতেই সত্যিকার বমি শুরু হল। যা খায় কিচ্ছু পেটে তলায় না। মহাশ্বেতার স্থির বিশ্বাস হল এবার সে মারা যাবে। স্বামীকে ডেকে এক দিন বললেও, 'হ্যাঁ গো, তোমরা কি ডাক্তার-বদ্যি দেখাবে না, আমি এমনি বেঘোরে মারা যাব?” ঘুমের ঘোরে জড়িয়ে জড়িয়ে অভয়পদ সাড়া দেয়, ও, তুমি মরছ নাকি? তা তো জানতুম না ।' “তা জানবে কেন। তোমার আর কি, আমি মলেই তো তোমার সুবিধে। আমি কালো পেঁচী—আমাকে তোমার মনে ধরে নি, তা কি আর আমি জানি না। সেইজন্যই বুঝি আমার চিকিচ্ছে করাচ্ছ না? মরতে তর্ সইবে না—আর একটা বিয়ে করে আনবে।” ‘তা তো সত্যিই—নইলে আমার চলবে কি করে বল।' পরক্ষণেই অভয়পদ নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। নিঃশ্বাসের শব্দ গভীর হয়ে আসে। মহাশ্বেতা যেন কিছু বুঝতে পারে না। লোকটা তো সত্যি এত খারাপ নয়। যা করা উচিত বলে মনে করে-তা তো কোনটা পড়ে থাকে না। তবে ওর এমন অসুখ দেখেও নিশ্চিন্ত হয়ে থাকে কি করে ? শাশুড়িও তেমনি নির্বিকার। তিনিও তো দেখছেন—কই কখনও তো বলেন না—যে একটা ডাক্তার ডাক্, কি হাসপাতাল থেকে এক মোড়া ওষুধ এনে খাওয়া। বরং আজকাল যেন একটু বেশী টিক্টিক্ করেন—চলাফেরা সবেতেই টিটিক্। সন্ধ্যের পর বড়-একটা ঘরের বার হতে দেন না, ঘাটে যাওয়া তো একেবারে বারণ হয়ে গেছে, বাইরের কারুর সামনে পর্যন্ত যেতে দেন না——তাতে নাকি নজর লাগবে। আর এক নতুন উপসর্গ হয়েছে, সন্ধ্যার আগেই খোঁপাতে একটা খড়কে কাঠি গুঁজে দেন। এ আবার কি অদ্ভুত ব্যাপার বোঝে না মহাশ্বেতা। দু-একদিন জিজ্ঞাসাও করেছে শাশুড়িকে, জবাব পায় নি, মুখ টিপে হেসেছেন ক্ষীরোদা। অবশেষে একদিন আর থাকতে না পেরে সে শাশুড়ির মুখের ওপরই বলে বসল, 'মা আমাকে একবার বাপের বাড়ি পাঠাবেন?’ “তা কেন পাঠাব না বৌমা? কিন্তু হঠাৎ এ খেয়াল কেন গা বাছা!' “মনে হচ্ছে আর তো বেশী দিন বাঁচব না। শেষ দেখা দেখে আসি!' মুখখানাকে যতটা সম্ভব গিন্নীবান্নীর মতো গম্ভীর করে বলে মহাশ্বেতা। ‘ষাট্! ষাট্! ওমা ও কি অলুক্ষণে কথা গা বৌমা। ষাট্— তুমি মরতে যাবে কি দুঃখে মা? ষাট্! ষাট্! অ মেজবৌমা, পাগলীর কথা শুনে যাও মা।'
গজেন্দ্রকুমার মিত্র (জন্ম: ১১ নভেম্বর - মৃত্যু: ১৬ অক্টোবর ১৯৯৪) তার জন্ম ১১ই নভেম্বর কলকাতা শহরে। বাল্যশিক্ষা শুরু হয় কাশীর এংলো-বেঙ্গলী স্কুলে। কলকাতায় ফিরে এসে ঢাকুরিয়া অঞ্চলে গজেন্দ্রকুমার বসবাস শুরু করেন এবং বালিগঞ্জ জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। স্কুল জীবন অতিক্রম করে অতঃপর তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে বই এর ব্যবসায় যোগ দেন ও ১৯৪০ সাল পর্যন্ত্য বই বিক্রি করেছেন গজেন্দ্রকুমার। স্কুল শিক্ষা সমাপ্তির কিছু পরেই বন্ধু সুমথনাথের সঙ্গে মাসিক সাহিত্যিক পত্রিকা 'কথাসাহিত্য' শুরু করেন| ১৯৩৬ সালে তৈরি হয় মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনা সংস্থা। গজেন্দ্রকুমারের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'মনে ছিল আশা', গল্পগ্রন্থ 'স্ত্রিয়াশ্চরিত্রম' | ১৯৫৯ সালে তাঁর 'কলকাতার কাছেই' উপন্যাস আকাদেমি পুরুস্কারে সম্মানিত হয়| 'কলকাতার কাছেই', 'উপকন্ঠে', 'পৌষ-ফাগুনের পালা'-এই ট্রিলজিকে (ত্রয়ী উপন্যাস) আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য উপন্যাস বলে গণ্য করা হয়| পৌষ-ফাগুনের পালা ১৯৬৪ সালে রবীন্দ্র পুরুস্কার পায়| গজেন্দ্রকুমারের লেখনীর বিচরনক্ষেত্র বিরাট ও ব্যাপক, সামাজিক উপন্যাস, পৌরানিক উপন্যাস, ঐতিহাসিক উপন্যাস, ছোট গল্প.কিশোর সাহিত্য-সর্বত্র তাঁর অবাধ গত| সুদীর্ঘ ষাট বছরের অধিককাল ধরে তাঁর কয়েক হাজার ছোটগল্প ও পঞ্চাশটিরও বেশি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে| তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক, প্রকাশক ও অনুবাদক।