ফ্ল্যাপে লিখা কথা চার্লস ফার্গুসন আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের একজন দিকপাল। বিশ শতকের মার্কিন সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানে ঐতিহ্য শিক্ষাপ্রাপ্ত হলেও তিনি সাংগঠনিক ভাষা বিজ্ঞানে নিজেকে সীমিত রাখেন নি। ভাষা-সংগঠন ও তত্ত্ব গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি ভাষা-বৈচিত্র্যের মুখোমুখি হন।এক্ষেত্রে তাঁর ‘ডায়গ্লসিয়া’ তত্ত্বটি বিশ্লেষণী-অনু্কল্প হিসেবে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করেছে। সমাজ ভাষাবিজ্ঞানের অনুসন্ধানকে সুতীব্র করার ক্ষেত্রে ফিসম্যান প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানীর সঙ্গে তাঁর নামও অবশ্য উল্লেখ্য । তিনি বাঙলা প্রমিত রীতির (SCB) ধ্বনিতত্ব (Phonology) ও রূপতত্ত্ব (Morphology) নিয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট উপাধি পান। বাংলা ছাড়া তিনি আরবী ভাষাবিজ্ঞানেও মূল্যবান অবদান রেখেছেন।
চার্লস ফার্গুসর ভাষা-পরিকল্পনা ও দ্বিতীয় ভাষা অর্জন গবেষণাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন । তাঁর প্রণোদনায় শিশুর ভাষা অর্জন সম্পর্কিত অনুধ্যান গতিবেগ লাভ করে। এক্ষেত্রে ‘Baby talk' বিষয়ক অনুসন্ধানে তিনি অনেককে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
চার্লস ফার্গুসন রচনা স্বচ্ছতা ও প্রাঞ্জলতা জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। কঠিন বিষয়কে সমজবোধ্য করার ক্ষেত্রে ভাষাবিজ্ঞানের তাঁর জুড়ি পাওয়া দুঃসাধ্য । তিনি ভাষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানীদের পথিকৃৎ। চার্লস ফার্গুসন ও মুনীর চৌধুরীর যৌথ রচনা ‘The Phonemes of Bengali' একটি মৌলিক বিশ্লেষণধর্মী সারগর্ভ রচনা। বাংলা ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা চিরদিন ফার্গুসনের রচনা পাঠে উপকৃত হবেন।
আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী (২৭ নভেম্বর ১৯২৫ - ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১) একজন বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী, বাগ্মী এবং শহিদ বুদ্ধিজীবী। তিনি তৎকালীন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানাধীন গোপাইরবাগ গ্রামে। তিনি ছিলেন ইংরেজ আমলের একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরীর চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। কবীর চৌধুরী তাঁর অগ্রজ, ফেরদৌসী মজুমদার তাঁর অনুজা। ১৯৪৯-এ লিলি চৌধুরীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। মুনীর চৌধুরী ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল (বর্তমান ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেন এবং ১৯৪৩ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে আইএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স (১৯৪৬) এবং মাস্টার্স (১৯৪৭) পাস করেন, উভয় ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় শ্রেণীতে। তিনি ছিলেন সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র। বক্তৃতানৈপুণ্যের সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনের প্রথম বছরেই, ১৯৪৩ সালে, হলের সেরা বক্তা হিসেবে প্রোভোস্ট্স কাপ জেতেন। ১৯৪৬ সালে নিখিল বঙ্গ সাহিত্য প্রতিযোগিতায় সর্বাধিক সংখ্যক পুরস্কার জেতেন। ১৯৪৯ সালে মুনীর চৌধুরী খুলনার ব্রজলাল কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি কিছুদিন বাংলাও পড়িয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে মুহম্মদ আবদুল হাই অকালে মৃত্যুবরণ করলে তাঁর স্থানে মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হন। ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত একটি ভাষাতাত্ত্বিক সম্মেলনে যোগ দিতে যান। মুনীর চৌধুরী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে পাকিস্তান সরকারের হাতে বন্দী হন। বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি তাঁর বিখ্যাত নাটক কবর রচনা করেন (১৯৫৩)। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের যে কোন ধরনের সংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। ১৯৬৬ সালে রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান প্রচারে পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ করেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলা বর্ণমালাকে রোমান বর্ণমালা দিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিলে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে সে আন্দোলনের সমর্থনে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব বর্জন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুনীর চৌধুরী ফিরে আসার কিছুকাল পরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তাঁর কিশোর ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চলে যায়। এসময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আদেশে মে-জুন মাসে ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে এবং জুলাই মাস থেকে কলা অনুষদের ডীন হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর মুনীর চৌধুরীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের সহযোগী আল-বদর বাহিনী তাঁর বাবার বাড়ি থেকে অপহরণ করে ও সম্ভবত ঐদিনই তাঁকে হত্যা করে। তবে এর কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায় নি।