তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫) বাংলাদেশের ইতিহাসে এক স্মরণীয় নাম। পাকিস্তান আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা-আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের যুক্তিযুদ্ধে রয়েছে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। তিনি মনে-প্রাণে ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর খড়্গহস্ত হলে তিনি বসে থাকতে পারেননি। মাতৃভাষা বাংলা এবং এ ভূ-খণ্ডের মানুষের চিরকাল লালিত সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা কিছুতেই সহ্য করতে পারেননি। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পূর্বেই যুক্ত হয়েছিলেন গণ-আজাদী লীগ নামক অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল আদর্শের রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে, যে সংগঠনের প্রধান অঙ্গীকার ছিল বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। একইভাবে গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ প্রভৃতি সংগঠন প্রতিষ্ঠায় যুক্ত হয়ে তিনি এগুলোর মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে কাজ করেছেন। ভাষা-আন্দোলনের পর একুশের চেতনা লালন ও বাস্তবায়নে কাজ করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি যে অবদান রেখেছেন, তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে তাঁর নেতৃত্ব শিরোধার্য করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনেও রাখেন অসামান্য অবদান। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকে দলে ভেড়াতে ব্যর্থ হয়ে ৩রা নভেম্বর জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে মাথা উঁচু করে জীবন দিয়ে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তার জন্য সর্বকালের মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। গ্রন্থটির বিশেষত্ব হলো, এতে প্রচুর তথ্যসন্নিবেশ করা হয়েছে এবং সুনির্দিষ্টভাবে তার সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে। এজন্য ইতিহাসের অনুসন্ধানী গবেষক যেমন গ্রন্থটি পাঠে উপকৃত হবেন তেমনি সাধারণ পাঠক ও নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে ইতিহাসের অজানা নানা বিষয়। সচেতন ও সযত্ন প্রয়াস সত্ত্বেও তথ্যবিভ্রাট ও মুদ্রণগত ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা অসম্ভব নয়। গোচরে এলে পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধন করা হবে। গ্রন্থটি পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে আমার শ্রম সার্থক হবে।
ড. এম আবদুর ইতিহাস-ঐতিহ্যসন্ধানী গবেষক। সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ তিরিশের অধিক। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো - ভাষা-আন্দোলন-কোষ, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন : জেলাভিত্তিক ইতিহাস, ত্রিশোত্তর বাংলা কাব্যে বিচ্ছিন্নতার রূপায়ণ, বাংলা কাব্যের স্বরূপ ও সিদ্ধি-অন্বেষা, শহীদ কাদরীর ত্রিভুবন, রবীন্দ্রনাথ উত্তর-আধুনিকতা ও বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন, পাবনায় ভাষা-আন্দোলন, সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলন, আনিসুজ্জামান, সুচিত্রা সেন, বন্দে আলী মিয়া : কবি ও কাব্যরূপ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা, আওয়ামী লীগ ও ভাষা আন্দোলন প্রভৃতি। নেশা লেখালেখি হলেও পেশা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা। এক সময় ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ও কলা অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার লাভ করেছেন। তাঁর জন্ম ১৯৭৬ সালের ১ ডিসেম্বর। জন্মস্থান পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার গৌরীগ্রামে।