আমরা যারা উপমহাদেশের অধিবাসী তারা পৌনে দুশ বছর ব্রিটিশের কলোনি থাকলাম। তাদের রোপণ করা ধর্ম নামক এক বিষবৃক্ষের ফুল-ফলে আমরা আজ আড়ষ্ট প্রায়। ৪৭-এর দেশবিভাগ বাংলা আর পাঞ্জাব মুল্লুকে কতটা সুফল বয়ে এনেছে তা ইতিহাস জানে আর জানে ভুক্তভোগীরা। সাদত হাসান মান্টোর শানিত লেখায় এর বিবরণ আমাদের রক্তকে হিম করে দেয়। আর আজকের বাংলাদেশের গল্পটা তো আরও ভয়ংকর। ২৩ বছরের একটি স্বাধীন দেশ আবার এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক জটিল সমীকরণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে না গিয়েও কেবল সাদা চোখে দেখা যায় তৎকালীন দুই পাকিস্তানের মধ্যেকার রাশি রাশি বৈষম্যের চিহ্ন। একজন শ্রমজীবী মানুষ কিংবা ভূমিহীন প্রান্তিক মানুষও বুঝতে পারে অসাম্যের রাষ্ট্রকাঠামোকে। তাই বাংলার সহজ-সরল মানুষেরা ইতিহাস তৈরির নেশায় মেতে ওঠে। যুদ্ধটা অনিবার্য ছিল যার কারণ অনেক গভীরে প্রোথিত। পাকশাসকদের ষড়যন্ত্রের নীল নকশা, Ôঅপারেশন সার্চলাইটÕ, নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যার পরিকল্পনা আর ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার প্রবণতায় একরাতে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি নিজ গৃহে পরবাসী হয়ে যায়। বাংলার শ্যামল প্রান্তর বুটের তলায় থেঁতলে যায়, বাতাস ভারি হয়ে যায় বারুদ আর পোড়া মাংসের গন্ধে। তখন নতুন ইতিহাস, সার্বভৌমত্ব, নিজস্ব পতাকা আর মানচিত্রের জন্য লড়াইটা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ এই জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কেবল ক্ষুধামুক্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি ভূখণ্ডের জন্য সেদিন মানুষ সর্বস্ব পণ করে লড়াইকে সঙ্গী করে। আমাদের সাহিত্যে এই যুদ্ধ আর এর প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তিমানুষের পাল্টে যাওয়া জীবনের সমীকরণ আঁকা হয়েছে। যুদ্ধের আঁতের কথা, ক্ষমতার শেকড়ের কথা, যুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার কথা ব্যক্ত হয়েছে যুদ্ধের সাহিত্যে। যুদ্ধ যে একটা জাতির জীবনে নির্দিষ্ট একটা সূচি বা দিন-ক্ষণ মেনে আসে নাÑএটা যে বহমান এবং নিরন্তর বহমান একটা প্রক্রিয়া সেটাও সংবেদনশীল কথার কারিগররা তাঁদের সৃষ্টিতে সযত্নে বিন্যস্ত করেন। যুদ্ধদিনের জীবনকে বহুকৌণিকভাবে দেখার প্রয়াস লেখায় লক্ষ যায়। যেগুলো বোধ আর বোধির গভীরতম তলদেশে ছাপ ফেলে যায়। পাঠ বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি ব্যবহার সেসব বিষাদময়তায় ভরা বিচিত্র ডিসকোর্সকে এই গ্রন্থে কিছুটা সন্নিবেশিত করার চেষ্টা করেছি আমরা। আর সাহিত্যের নির্যাসকে তথা জীবনের গল্পকে তার পুরোনো পাঠকৃতি এবং নতুন অনুভবে জারিত করে যাপিত জীবনের সঙ্গে অঙ্গীকৃত করার বাসনায় এই লেখার আন্তর্প্ররেণা।