কবিতার থাকে ভিতর-বাহির। কোনও কোনও যুগের কবিতা গড়পড়তায় বিষয় ও ভাষার তাল ধইরা রাখতে পারে নাই। যেমন তিরিশের কবিতারা ভিতর দিয়া বাহিররে বহিষ্কার করছিল, মানে আমাদের জবানরে অচিন ধাঁধায় আটকায়া দিছিল। কিন্তু ফয়েজ আলমের নতুন কবিতার বই ‘আমারে উড়াও ধুলা', বাহির দিয়া ভিতরে যাইতে পারার নয়া যাত্রা করে। ‘কিছু কথা হুঁশের আড়ালে পড়তেছে/ কলবে গায়েব থাকতেছে কোনও কোনও কথা'। brফয়েজ আলমের কবিতার বাহিরটা হইল মানুষ হিসাবে বাইড়া ওঠে জীবনের ভ‚গোল ও সমাজ-সংস্কৃতির চিরচেনা বহিঃপ্রকাশ। বাঙালির জবানের মর্ম ও আওয়াজে পাইবেন ‘হুঁশ', ‘গায়েব', ‘মনমরা রৈদ', ‘নিরাক' এমন আরও অগণিত কবিতার বাকল। br তয় বাকলেই শেষ না, আমারে উড়াও ধুলা গায়েবি আত্মার কাছে আধুনিক কী-বোর্ড বাজাইতে বাজাইতেও সেজদা দিয়া ধুলা উড়ার পথেও বদলাইতে থাকে। বদলাইতে বদলাইতেই ধুলার আগে যেন কবি একখান বিন্দু। পড়তেছেন, অনন্ত শূন্যর মাঝে কতো কতো কাল! ফয়েজ আলমের কবিতা মর্মে মরমি। তিরিশে শুরু হওয়া অনুবাদ বাংলা, সংস্কৃতায়িত বাংলার রেশ কাটাইতে না-পারা কয়েক যুগের পর বাঙালের জবানের সঙ্গে কাব্যিকতার মেল তৈরি করতেছে ফয়েজ আলমের কবিতা। নয়া কাব্যভাষার দিশা। তাছাড়া প্রেমে, ভানে, পুঁজিসভ্যতার রোগের প্রতীকী গাঁথুনিতে ইহজগতের আয়নায় অচিনপুররে দেখতে দেয় তাঁর কবিতা। ধুলা! পাঠক মহাকালের কাছে তুচ্ছই বোধ করবেন। কাব্যগ্রন্থটির ভাবগত বিশালত্বে বিলীন হয়া যাওয়ার আছে।
ফয়েজ আলমের চিন্তার ধরন, রোখ ও জায়গা আমাদের প্রচলিত ধারার সাহিত্যভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা থেকে ভিন্ন। একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক, উত্তর-উপনিবেশী তাত্ত্বিকা উপনিবেশী শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখী প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশী আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁর লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাস করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল, ডিগ্রি লাভ করেন ফয়েজ আলম। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি (গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাঈদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশী মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২)।