'পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোড়া করে দেব'- কথাটা শুনলেই মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অনভ্যস্থ অনুভূতি জেঁকে বসে। এটা অঞ্জন দত্তর তুমুল জনপ্রিয় গান। অঞ্জন দত্তর ভাষ্যমতে, 'সাম্প্রদায়িক ইস্যু নিয়ে একটা গান, অথচ লোকে ধেই ধেই করে নাচে। আনন্দ করে।' অঞ্জন দত্তর গানের নিগূঢ় নির্যাস এখানেই। একটা গান হচ্ছে টেলিফোন কলে। গানটা যখন লেখা হয়েছে তখন ল্যান্ডফোনের সেই মান্ধাতার আমল। কিন্তু বোতাম টিপে বিশ্বভ্রমণের যুগেও এই গানের আবেদনে একরত্তি ভাটা পড়েনি। কনসার্টে অঞ্জন যখন গেয়ে ওঠেন, 'এটা কি টু ফোর ফোর ওয়ান ওয়ান থ্রি নাইন', মুহূর্তেই সেটা জনসমুদ্রের কোরাস-বাষ্পে পরিণত হয়। হাতের মোবাইল শূন্যে উঁচিয়ে স্থিরচঞ্চল বেগে আরম্ভ হয় পুরনো অঞ্জনের নতুন দৃশ্যধারণ।' তখন অঞ্জন হয়ে ওঠেন আজকের। এই সময়ের। চূড়ান্ত সমকালীন। এই সমকাল-প্রাসঙ্গিকতাই অঞ্জন দত্তর জাত্যাভিমান কিম্বা কৌলিন্যের আমূলরহস্য। উন্মাতাল মধ্যযৌবনে অঞ্জন অবলীলায় গানের মধ্যে বলে দিলেন, 'আমার রাস্তা হাঁটে, আমি হাঁটি না।' সেই গানেই আরেকটা লাইন, 'আমার বয়েস বাড়ে আমি বাড়ি না।'' এটাই অঞ্জন। তিনি, তাঁর গানের শ্রোতা সেই পনের-কুড়িতেই আঁকড়ে পড়ে আছে। হয়তো একদিন বাবাটা শুনেছিল, আজকে ছেলেটা শুনছে। আর অঞ্জনের বুড়ো গিটার আরও অঞ্জনাঢ্য হয়ে উঠছে। অঞ্জন দত্ত তাঁর গানে সেই স্মৃতিশোভিত দার্জিলিং, এই পুরনো কলকাতা, এই বাস-ট্রাম-ফেরিওলা, পার্ক স্ট্রীট, এন্টালি মার্কেট, ডক্টর লেনের ঘুপচি গলি, নোনাধরা মলিন একটা বাড়ির অনেক-অনেক দুঃখকে নিয়ে এসেছেন চরিত্রের ভিতর দিয়ে।' তুমুল আত্মোৎকর্ষ ব্যঞ্জনায় এখানে দোল খায় অঞ্জনের বিমূর্ত নস্টালজিয়া। কিন্তু এই দুঃখগুলোকে কোথাও গিয়ে তিনি সেলিব্রেট করেন।' অঞ্জন নিজেই একটা মুসলমান বাচ্চাছেলে হয়ে পড়ছে জবড়জং আলোকসজ্জাময় পুজো নয়; ক্রিসমাসের দিনে। সেখানে ছেলেটি আলীবাবা। সে চারটা মুরগি ছাড়িয়ে একটা টাকা পায়। অঞ্জন সেই ছেলেটি হয়েই বলছে, 'স্বপ্ন দেখি ঘুড়ি ওড়াই কালো আকাশে।'' অঞ্জনের প্রত্যেকটা গান অঞ্জনের জীবনের অমূল্য সম্পদ। অঞ্জন দত্ত এক সময় পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন। গল্প বলার ভূত তাঁর কাঁধে চেপে বসে আছে জীবনভর। বড়দিনের কলকাতাকে নিয়ে রিপোর্ট; তাতে শিশুশ্রম বলে এই ছেলেটার প্রতিবেদন ছাপতে দিল না দপ্তরপ্রধান। অঞ্জনের তাতে মন খারাপ হয়েছিল। সেই মন খারাপের সাদাপাখিটাই পরে গান হয়ে গেছে।
বিচিত্র পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে নিজেকে আবিষ্কারের আনন্দ নিয়ে লিখেন সাজ্জাদ হুসাইন। বিরল মানুষ এবং প্রকৃতি তার লেখার প্রাণশক্তি। লেখার জন্য কখনও ঢুকে পড়েন দার্জিলিংয়ের মেঘ-কুয়াশার মধ্যে, অঞ্জন দত্তকে সঙ্গে নিয়ে। সেখানে গিয়ে অদ্ভুত নস্টালজিয়ার মধ্যে ডুবে গিয়ে রচনা করেন অঞ্জন দত্তর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘অঞ্জনযাত্রা’। এরপর আবার থিয়েটারের অঞ্জনকে নিয়ে চলে যান কলকাতার হাতিবাগানের ধসে পড়া থিয়েটারপাড়ায়। সেখানে প্রখর রোদ্দুরে অঞ্জন দত্তকে সাথে করে চলে যান নটী বিনোদিনীর বাড়ির সামনে। রাস্তার মাঝখান বরাবর দাড়িয়ে থাকা গিরীশ ঘোষের বাড়ির কম্পাউন্ডে। ম্যাজিক্যাল থিয়েটার ‘সারকারিনা’য়। সেই সূত্রে ‘ছাপাখানার ভূত’-এর উদ্যোগে ঢাকার মঞ্চে প্রথম মঞ্চস্থ হয় অঞ্জন দত্তর প্রথম নাটক ‘সেলসম্যানের সংসার’। সাজ্জাদ লিখেন অঞ্জন দত্তর নাট্যজীবন নিয়ে দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘নাট্যঞ্জন’। খুড়ে খুড়ে খুজে বের করেন অন্য এক অঞ্জনকে। এরপর সাজ্জাদ বেরিয়ে পড়েন মৃত্যুর অপার রহস্যময়তা জানার সন্ধানে। ঈশ্বরবিশ্বাস, পরকাল, পুনর্জন্ম, আত্মা-শরীর, মহাকাল ছাপিয়ে বের করতে চান কর্মের বিশালতাকে। সেই ভাবনা থেকে ৩ খণ্ডে রচিত হয় নন্দিতজনদের নিয়ে বিশেষ সংকলনগ্রন্থ ‘এখানে মৃত্যু নেই’। এই গ্রন্থের কাজ চলতে চলতে অনন্তের যাত্রায় ছুট দেন সেইসব নন্দিতজনদের কেউ কেউ। চলে যান নবনীতা দেবসেন, মুর্তজা বশীর, নিমাই ঘোষ, নিমাই ভট্টাচার্য, আমজাদ হোসেন… তারা অন্তর্লোকে চলে যান। কিন্তু তারা রয়ে যান কর্মে। আর দিয়ে যান ঈশ্বরবিশ্বাস, মৃত্যুচেতনা, মানবজীবন, পরকাল, পুনর্জন্ম, মহাকাল নিয়ে নিজস্ব ভাবনার কথা। সেগুলো মায়া দিয়ে রচনা করেন সাজ্জাদ। সাজ্জাদ হুসাইন আবিষ্কার করেন কবীর সুমনের গানের বাইরের এক্সাইটিং এক সত্তাকে। তার আত্মদর্শন নিয়ে লিখেছেন ‘কবীরা’। লিখেছেন চারুলতাখ্যাত শিল্পী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের থিয়েটার, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, পূর্ণেন্দু পত্রীসহ নানান বিরল শিল্পীদের সাথে পরিভ্রমণের আদ্যোপান্ত নিয়ে আত্মকথনমূলক গ্রন্থ ‘মাধবীর জন্যে’।তার লেখা বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য দুই শিল্পী ববিতা ও এটিএম শামসুজ্জামানকে নিয়ে আত্মকথনমূলক গ্রন্থও প্রকাশিত হয়ে গেছে এরইমধ্যে। বই দুটির নাম যথাক্রমে ‘বিস্ময়ে ববিতা’ ও ‘আমি আমি’।দুই বাংলার কালোত্তীর্ণ গানের দল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র সকল সদস্যদের সাথে আড্ডা, গল্প, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে করে ৩ বছরের পরিভ্রমণ শেষে রচনা করেন একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ ‘মহীনের ঘোড়াগুলির গান’। এইসব পথ পেরিয়ে সাজ্জাদ হুসাইন এখন বেরিয়ে পড়তে চান অন্য পথে। যেখানে আরও আরও অদ্ভুত মানুষেরা রয়েছে। রয়েছে প্রকৃতি। রয়েছে বিস্ময়। যা ফেলে আসা পথকে নতুন পথের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।চিন্তা-চেতনার উস্কানিতে অক্লান্ত হেটে চলের এই আর্বান পথিক…