ভূমিকাঃ কবিতা যখন শেখড়ের কথা বলে তখন কবির অন্তর্নিহিত সত্ত্বাকে আমরা দেখি বিচিত্র ছন্দে খেলা করে। কবি মুকলেছ উদ্দিন লিখেছেন তাঁর জন্মস্থান মদনকে নিয়ে। বইটির নাম "মদনের বিলুপ্ত ইতিহাস ও লোক, সংস্কৃতি"। বইয়ের পান্ডুলিপিখানি আমি পড়েছি। এখানে একটি কথা অবশ্যই বলতে হবে তিনি এক শিখড় সন্ধানী কবি। আমরা তাঁর লেখায় খুঁজে পেয়েছি মদন উপজেলার বিলুপ্তপ্রায় ইতিহাসের কিছু মূল্যবান উপকরণ। কবিতা তাল—ছন্দ—স্বাদে ইতিহাসকে অধ্যয়ন করার পৃথক একটা আনন্দ আছে। কবি তাঁর জন্মভিটা থেকে শুরু করে মদনের কতো নিভৃত অখ্যাত পল্লীকে জাগ্রত করে তুলেছেন। যেনো ভাটির হাওর এলাকায় পুনরায় জেগে উঠেছে এক একটি জলমগ্ন গ্রামে। সেই জল হিজলের দেশের কবি মুকলেছ উদ্দিন মদন এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি, প্রদান, হাট—বাজার, মুক্তিযুদ্ধে মদনের অবদান এসব কিছুই তুলে এনেছেন কবিতায়। এ দিক থেকে এটি একটি বিরল কাব্যগ্রন্থ। উল্লেখ্য, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে মদনের রয়েছে এক বীরত্বব্যাঞ্জক ইতিহাস। এই মদনেই পাক বাহিনীর সঙ্গে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের টানা সাতদিন ব্যাপী একটানা যুদ্ধ হয়েছিলো। তিনি বি এল এফ মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ সমাপন করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই বইটিতে সেই যুদ্ধকেও দেখা যাবে কবিতার ছন্দে। বস্তুত ইতিহাসের মতো একটি কাঠখট্টা বিষয়কে তিনি তাঁর কলমের নিপুণ আঁচড়ে নিখুঁত চিত্রায়ন করেছেন। কবি মুখলেছ উদ্দিন জন্মেছেন গ্রামে, বেড়ে উঠেছেন গ্রামে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ন্যায় তিনিও গ্রামপিপাসু হৃদয় ধারণ করেন। যে কারণে গ্রাম সমাজের চিত্রটি তিনি আঁকতে পেরেছেন। এটি যেমন আনন্দের, তেমনি গৌরবের। গ্রামে যেমন সহজ সরল জীবন, তেমনি তাঁর কবিতার ভাষাটুকুও সহজবোধ্য। হাওরের জল, নৌকোর রূপ, কষ্টকর রাস্তাঘাট, পুরনো ঘরবাড়ি, গৃহস্থালি,সালিস—দরবার, এমনকি ইউনিয়নের চিত্রটিও দেখা যাবে তাঁর কবিতায়। মদনবাসীর জন্য এ বইটি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হয়ে থাকবে। তেমনিভাবে অন্য আর এক কবিও নিজ এলাকার ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে পদ্যচয়নে কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত হবে বলেই আমার বিশ্বাস। বইটির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো ঐতিহ্যের সাথে গ্রামীণ সংস্কৃতিকে কাব্যিক ছন্দে রূপায়ন করা। নৌকা বাইচ থেকে জারি—সারি, বিয়ের আসর থেকে গ্রামীণ খেলাধুলা, গানবাজনা থেকে যাত্রাপালা , ফসল ফলানো থেকে কেশকামলা, মাছ ধরা থেকে নারীসমাজের চিত্র প্রভৃতি হরেক রকম উপাদানে সাজিয়েছেন তিনি তাঁর কবিতার উপাচার। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, বইটিতে স্পষ্টতই দু'টি ভাগ রয়েছে। এক অংশে যেমন আছে ট্রাডিশনাল কবিতা, তেমনি অপর অংশে রয়েছে গদ্যকবিতা। একই গ্রন্থে এ যেনো কবির এক কাব্যিক পরীক্ষা—নিরীক্ষা। পাঠক সমাজ ভিন্ন ভিন্ন স্বাদে উপভোগ করতে পারবেন কবিতাগুলো। আমি বইটির বহুল পঠন—পাঠন ও প্রচার কামনা করি। প্রফেসর ননী গোপাল সরকার আর্যগৃহ, নেত্রকোণা।