এই উপন্যাসটি ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। পুস্তকাকারে প্রকাশ করার সময় অনেক পরিবর্ত ন ও পরিবর্জস্টেন করা হয়েছে।- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শনের গা ঘেঁষে কারখানার লম্বা শেড। গেটের পাশে পিতলের ফলকেও নাম লেখা আছে ছোট ছোট অক্ষরে। আলকাতরা দিয়ে বাইরের দেওয়ালে বিরাট বেমানান হরফে লেখা-নব শিল্পমন্দির। এই ছোট নগণ্য স্টেশনটি ঘেঁষে একক শিল্প প্রচেষ্টার অভিনবত্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এত বড় হরফ সন্দেহ নেই। কিন্তু পথের সঙ্গে সমান্তরালভাবে গড়া ইটের দেওয়াল ও টিনের ছাউনিওলা লম্বাটে চালা ও লোহার চিমনিটাই সে কাজ আরও ভালোভাবে করছে, বেখাপ্পা হরফ দিয়ে এ-রকম ঘোষণার কোনোই দরকার ছিল না। জনরে পড়ার মতো এ-রকম আর কিছুই নেই স্টেশনে বা আশেপাশে। স্টেশনের সংলগ্ন লাল ইটের ঘর কয়েকটি যতদূর সম্ভব ছোট এবং সংক্ষিপ্ত। স্টেশন মাস্টারের দু-কামরার কোয়ার্টারটি দেখলে মনে হয় ছাদে মাথা ঠুয়ে যায় না তো, পা ছড়ি য় শুতে পারে তো? পথের দু-পাশে শুধু খড় ও টিনের কতকগুলি ঘর এবং চালা, মাত্র কয়েক ঘর মানুষের বসবাস ও দোকান চালাবার প্রয়োজনে এগুলি উঠেছে। কাছাকাছি নাগালের মধ্যে বড় গ্রাম নেই। স্টেশনের লাগাও বসতিটার মতোই এখানে-ওখানে থোপা-থোপা বসানো ছাড়া-ছাড়া বসতি, ছোট ছোট কাঁচা কতকগুলি ঘরের সমষ্টি। গ্রাম অবশ্যই আছে, বাংলার সর্বত্রই ঘন ঘন গ্রাম। স্টেশন থেকে একটু দূরে দূরে পড়েছে গ্রামগুলি। যেন সযত্নে হিসাব করে সমস্ত বড় বড় গ্রাম থেকে যতদূর সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখতেই স্টেশন করার জন্য এই স্থানটি বেছে নেওয়া। আসলে কিন্তু তা নয়। এখান থেকেই বারতলার জমিদার বাড়ি সবে চেয়ে কাছে হয়, মাইল চারেক। অন্য গ্রামের হিসাব দরাই হয়নি। স্টেশনের নামও বারতলা। দু-পাশের স্টেশন দুটি বারতলা থেকে বেশি দূরে দূরে নয়। ওই দুটি স্টেশন থেকেই এই এলাকার বেশির ভাগ গ্রামে যাতায়াতের সুেবিধান বারতলায় তাই যাত্রীর ভিড় হয় না। প্ল্যাটফর্মে হাটলে চোখে পড়ে এখানে-ওখানে ঘাসের চাপড়া গড়িয়ে আছে লাল কাঁকর থেকে দিয়ে। স্টেশন থেকে বারতলা পর্যন্ত সিধে রাস্তার দু-পাশের কয়েকটি ছোটখাটো গ্রাম আর ওই বারতলার যাত্রীরাই শুধু এই স্টেশন ব্যবহার করে।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।