জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রথম পর্বের পাঁচটি কাব্য কাল-ক্রমিকভাবে প্রথম পাঁচ শিরোনামের এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কাব্যগুলো হলো- ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’, ‘আমার সশস্ত্র শব্দবাহিনী’, ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি’, ‘অগ্নিময়ী হে মৃন্ময়ী’ ও ‘আমরা তামাটে জাতি’। এরমধ্যে কবি প্রথম কাব্য শোণিতে সমুদ্রপাত প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম কাব্যেই তিনি জানিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর প্রকট উপস্থিতির উজ্জ্বল বার্তা। দ্বিতীয় কাব্য আমার সশস্ত্র শব্দবাহিনী প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে। এ কাব্যে কবি সমকাল ও পরিপার্শ্বকে ধারণ করেছেন অনন্য দ্যুতিতে। একই বছর কবির তৃতীয় কাব্য ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি’ প্রকাশিত হয়। এ কাব্যে একজন নিষ্ঠ প্রেমিক হিসেবে কবি নিজেকে প্রকাশ করেন। তিনি নিজেকে এ মাটির সন্তান দাবি করেন এবং অনার্য প্রেয়সীর প্রতি নিজের প্রেম এবং নিজেকে সর্বাংশে নিবেদন করেন। এরপর প্রায় পাঁচ বছর বিরতি দিয়ে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে কবি প্রকাশ করেন চতুর্থ কাব্য ‘অগ্নিময়ী হে মৃন্ময়ী’। এই কাব্যে কবি একই শিরোনামের পঞ্চাশটি কবিতা সংকলন করেছেন। পরের বছর ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় কবির পঞ্চম কাব্য ‘আমরা তামাটে জাতি’। মূলত এই কাব্যই কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে ‘জাতিসত্তার কবি’ অভিধায় পরিচিত করে তোলে। জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার অনন্যতার প্রথম স্বাক্ষর এই প্রথম পাঁচ-এর কাব্যসংকলন।
মুহম্মদ নূরুল হুদা ১৯৪৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ সেকান্দর ও মাতা আঞ্জুমান আরা বেগম। মূলত কবি তিনি। তবে কথাসাহিত্য, মননশীল প্রবন্ধ ও অনুবাদসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তিনি বিচরণশীল। অতিপ্রজ ও সব্যসাচী এই লেখকের স্বরচিত, অনূদিত ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা শতাধিক। মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রাপ্ত পুরস্কারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), যশোর সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), আবুল হাসান কবিতা পুরস্কার (১৯৮৩), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কক্সবাজার পদক (১৯৮৯), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৪), আহসান হাবীব কবিতা পুরস্কার (১৯৯৫), যুক্তরাষ্ট্রের আই.এস.সি ঘোষিত পয়েট অব ইন্টারন্যাশনাল মেরিট ও পয়েট অব দ্য ইয়ার (১৯৯৫), কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ কর্তৃক প্রদত্ত নজরুল জন্মশতবার্ষিকী সম্মাননা (১৯৯৯), জীবনানন্দ জন্মশতবার্ষিকী সম্মাননা (১৯৯৯), সুকান্ত পুরস্কার (২০০৪), একুশ-উনিশে ভাষা গৌরব শীর্ষক ত্রিপুরা রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সম্মাননা (২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১২) ইত্যাদি। ১৯৯৭ সালে তিনি তুরস্কের রাষ্ট্রপতি সুলেমান ডেমিরিল কর্তৃক বিশেষ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হন। ২০১৫ সালে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা দিয়ে। তারপর বাংলা একাডেমিতে চাকরি বদল। এখানেই বিকশিত তাঁর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সময়। তিনি নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির সদস্য-সচিব। বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের লেখকদের সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান সভাপতি। তিনি আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের প্রবক্তা। সাহিত্য-সাধনার পাশাপাশি সাহিত্য-সংগঠক হিসেবেও তিনি সর্বমহলে সমাদৃত।