রহমান মাঝিও এসেছিল হাটে। আজ মাছ নিয়ে নয়। ঘরের চালা খুলে নিয়ে এসেছিল বিক্রি করতে। অল্প কিছু টাকায় তা বিক্রি করে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় শুকনো মুখে বাড়ি ফিরছে। সারা জীবন শুনে এসেছে, দেখেছে নদীর এক পাড় ভাঙ্গে। কিন্তু এবার নতুন চর উঠায় নদীর দু-পাড়ই ভাঙ্গা শুরু হয়েছে। রহমান মাঝি ভাঙ্গন কবলিত বাড়ির কাছে এসে করুণ চোখে তাকায় ভিটার দিকে, ঘর-বাড়ি অনেক আগেই সরিয়ে ফেলেছে। আছে শুধু ভিটার মাটি আর বাবার কবর। অন্ধকারের মাঝেও তা এক নজর দেখে বুক ফাটা কান্না নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে আসে অস্থায়ী বসতিতে । তার স্ত্রী পাটশোলার আগুনে ভুট্টা পুড়িয়ে মাঝির হাতে দিয়ে বলে, খাও মাঝি, দিনডে গেল কিচ্চুই তো মুহত দেও নাই। মাঝি ভুট্টা খুলে মুখে দিয়ে উদাস হয়ে ভাবছে জীবনের এই দুর্বার ভার আর কত রকম ভাবে বহন করতে হবে। ক্রমেই অন্ধকার আরও ঘনীভ‚ত হয়ে ঘিরে ধরছে। চার পাশে শুধু পানির শব্দ। মাঝি ভুট্টা খাওয়া শেষ না করেই সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তার ভিটার দিকে হাঁটতে থাকে। পিছন থেকে ডাক দেয় মাঝির বউ... কুন্তি যাও এত আন্দারের মইদ্দে? চলতে চলতেই মাঝি উত্তর দেয়, তুমি ইন্তি থাহো, আমি ডন্ডেই আইমু, চিন্তে কইরো না। রহমান মাঝি গেছে অনেকক্ষণ হয়। কিন্ত এখনও ফিরেনি। মাঝির বউ চিন্তায় পড়ে যায়। সে এখানে-ওখানে খোঁজ করতে থাকে। কোথাও না পেয়ে উচ্চেঃস্বরে ডাকাডাকি করতে থাকে। আশপাশের অনেকেই আসে। মাঝি কোথায় গেছে জানতে চায়। মাঝির বউ কান্নার সুরে সুরে বলে, বাজারত থইনে আইসে ভুট্টা খাইলো। ভুট্টা মুহো দিয়েই কইলো, ভিটেত তনে এল্লা আহি। সেই মাইনষের আর উদ্দিশ নাই। ভিটে তো মুনে হয় ভাইঙ্গে গেছে, তাইলে কি... এই বলে সে আরও জোরে জোরে কাঁদতে থাকে... মোতালেব মাঝিকে উদ্দেশ্য করে বলে, নদীত মরবার গেছিলা ? নিঃশ^াস ছাড়তে ছাড়তে কান্নাজড়িত কন্ঠে মাঝি উত্তর দেয়, মরলে তো ভালাই অবো। তয় যমুনাত মরমু না। আক্কসী যমুনা বুকটারে ফালাফালা কইরা ফালাইছে। যমুনার কেন্নেই বেমাহেই আইজ ফকির। বাইচেও মইরা যাবার দশা হবানচি... হেই যমুনায় কেন ঝাপ দিমু? ইডে ভাইবলে কিবে? আরেখ খানে গিয়া মরমু, যমুনাত না। জলিল বলে, তাইলে কোঠাই গেছিলে? কাঁদতে কাঁদতে মাঝি বলে, বাজারত থইনে আসার সুুময় দেহি বাজানের কব্বরডা মেলাখানি ভাইঙ্গে গেছেগা। বাড়িত কোনো মুতেই মুন টিকল না। বুদ্ধি করলাম, যমুনা বেমাক কিছুই তো নিছে। বাজানরে একলা যমুনাত ভাসপের দিমুনা। তাই বাজানের শরীলের হাড্ডি-হুড্ডি গুইলে নিয়ে আইলাম। এহন থইনে বাজান আর আমি এক হঙ্গেই থাকমু। এই বলে মাঝি তার বাবার হাড়গুলোকে দেখিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে। তারা মাঝিকে বাড়িতে নিয়ে আসে। তাকে দেখামাত্র মাঝির বউ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ভাঙ্গা কন্ঠে মাঝি বলে, পরীর মাও, কান্দস ক্যা, এই নি আঙ্গরে বাজানরে। এহন থইনে আঙ্গরে সাতেই রাখমু। আর কোনো দিন ভুল কইরে সর্বনাশা যমুনার পাড়ত আমার বাজানরে রাখমু না। সারা জীবন কান্দে নিয়া বেড়ামু।