হাজার বছর পেরিয়েছে বাংলা কবিতা। এর মন্ময় অনুভূতির রং ও ব্যঞ্জনা সৃষ্টির শুরু হয়েছিল বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদে। তারপর সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম-মধ্যযুগ পেরিয়ে বর্তমান পর্যন্ত। এর অভিমুখ এখন অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। বাংলা কবিতারাশি রূপ-রসের ব্যঞ্জনায় সময়-স্বভাব ও কবিতা পার্সোনাকে ধারণ করে আছে নানামাত্রিক চিহ্নে-সংকেতে-রূপকল্পে আর কবিরা রেখে গেছে বাংলা কবিতার জন্য ঐশ্বর্য-ভূষণ-চিন্তন-পরিভাষা। কবিতা যে শুধু বিবরণ নয়, স্ফুট-স্ফটিক নয়-প্রছন্ন, বঙ্কিম, গভীরতম দ্যোতনার নির্যাস, শব্দ দিয়ে গড়া নৈঃশব্দের প্রতিমা তারই প্রকাশ ঘটেছে জায়েদ সানির ‘বিষণ্ন সার্কাস’ কাব্যটিতে। সেই সঙ্গে কাব্যটিতে রয়েছে কবির নান্দনিকবোধের সূক্ষ্মতা, রয়েছে মননশীল সৃজনশক্তির প্রাণবন্ত প্রয়াস। কবিতা একধরনের জীবন-সংগ্রাম, আত্মমুক্তি ও মানবমুক্তির সংগ্রাম, অনুধ্যান ও বিনির্মাণ কলা। নিঃসন্দেহে কবিতা ব্যক্তিবিন্যাস, সমাজবিন্যাস ও মানব বিন্যাসের এপিটাফ। জায়েদ সানির ‘বিষণ্ন সার্কাস’ ধারণ করেছে আলোচ্য গভীরতম সত্যটি। মানবজীবনের সার্বিক দুঃখবোধ, সামাজিক-রাষ্ট্রিক অব্যবস্থাপনাসহ অনাস্থা, অস্থিরতা, দুরাশা, ক্লেদ, কূটাভাস, বিরোধাভাস, সংশয়, নেতি, নৈরাশ্য, দ্রোহ তার কবিতার ভাবসম্পদ। ‘ বিষণ্ন সার্কাস’ ৪০টি কবিতার সংকলন। কাব্যটির ‘আত্মহত্যা’ শীর্ষক কবিতায় কবি স্বার্থপর মানুষের আত্মকেন্দ্রিক জীবনধারণকে ব্যঙ্গ করেছেন, আবার ‘ হারিয়ে ফেলা’ কবিতার মাধ্যমে ব্যক্তিক মানুষের শূন্যতাবোধ ও বিবিক্ত মন-মননের বিষয়টি অত্যন্ত নান্দনিক ভাবে উপস্থাপন করেছেন। এই কাব্যের নাম কবিতাটিতে যেন কবি জীবনতৃষ্ণা কাতর হয়ে নিজ জীবন ও অন্যজীবনের মধ্যে সমীকরণ করতে গিয়ে নির্মাণ করেছেন একাকীত্বের খাদ। ফলে পুরো জগৎটাই যেন হয়ে উঠেছে বিষণ্ণ সার্কাস। তাছাড়া এই কাব্যের ‘অজ্ঞাত’, ‘অনিমেষ মানুষ হতে চেয়েছিল’, ‘অসভ্যতার আদিম কৃমি’, ‘খাঁচা’, ‘উদ্বাস্তু’, ‘বিষণ্ন কবির ঠোঁট’ প্রভৃতি কবিতা কবির শৌর্য ও সৌন্দর্যের স্ফূর্ত। সর্ব বিবেচনায় কী বিষয় কী বক্তব্যে কী ভাব সম্পদে বাংলা সাহিত্যের বিদ্যার্থী এই তরুণ কবির কবিতা নান্দনিক সৃজনীক্ষমপ্রজ্ঞার সচেষ্ট প্রয়াস বলা যায় অবলীলায়। কবিতাগুলোর সৌন্দর্য, শুদ্ধতা, নাটকীয়তা, প্রসিদ্ধি কবিতাপ্রেমিকদের আকৃষ্ট করবে যদিও কবিতা মূলত সহৃদয়-হৃদয়সংবাদী পাঠকচিত্ত-সাপেক্ষ।