ভূমিকা সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। অনেক দূর এগিয়েছে মানুষ। বাংলাদেশ এবং দেশের মানুষও অনেক এগিয়েছে। বদলায়নি কিছু মানুষের মন ও মনন। এইসব মানুষের হাতে তথ্য ও উপাথ্য থাকলেও তারা বিভ্রান্তি থেকে বের হতে নারাজ। যেমন ধরুনÑছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক বিষয়ক বিভ্রান্তির বিষয়ে। এমন অভিজ্ঞতা হয়তো অন্যদেরও। টি-স্টল থেকে শুরু করে স্কুলের বারান্দা পেরিয়ে ওয়াজ মাহফিলেও সে বিভ্রান্তি যেনো আজও আলোচনার বিষয়। অপ্রাসঙ্গিকভাবে হলেও এসব জায়গায় রবীন্দ্রনাথের জাত-পাত উদ্ধার করতে ভুল হয়না। এতসব সমালোচনার জবাব দিতে বেশকিছু মূল্যবান গ্রন্থও পাওয়া যায়। তবে সমালোচকদের বইয়ের বিষয়ে আগ্রহ নাই। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু (বাস্তবে তিনি ভ্রাম্য ছিলেন) আর নজরুল মুসলমান এই বিষয়টাকেই গুরুত্ব দিয়ে সমালোচকদয় তাদের স্থানে অটল থাকছেন। এই বিভ্রান্তি দূরীকরণে আমাদের অগ্রজ গবেষকদের ধারাবাহিকতায় নিজে গল্পচ্ছলে অল্প লেখায় তা দূর করার চেষ্টা করেছি। রবীন্দ্রনাথের আরেক ¯েœহধন্য, রবীন্দ্রসঙ্গীত স্বরলিপিকর, সংগঠক ও শিক্ষক শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ওপর আমার সম্পাদনায় ইতোপূর্বে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। নানা সময়ে তাঁকে নিয়ে বিষয়ভিত্তিক লেখাও লিখেছি। এখানে নতুন একটি লেখা যুক্ত করেছি। ভেবে দেখেছি, তিনি তাঁর কর্মেও তুলনায় খুব কম পরিচিত; শুধু বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গেও এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখছি না। তাঁকে জানা এবং অন্যকে জানানো তো আমাদের দায়। আমার লেখা সেই দায়মুক্তির অংশ বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গে থাকাকালীন পূর্ব বাংলার বাউল গান তাঁকে খুব টেনেছিলো, বলা যায় তাঁকেও সমৃদ্ধ করেছিলো। এই বাউল গানের চেতনা তাঁর গানে আছে। এজন্য অনেক গবেষক তাঁকে রবীন্দ্র-বাউলও বলে থাকেন। যদিও রবীন্দ্রসঙ্গীত একেবারেই স্বতন্ত্র ও তুলনাহীন। সিরাজ সাঁই, লালন, হাছন নিয়ে তিনি অবগত হলেও হাওর অঞ্চলের অন্য বাউল সাধকদের বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন কি না তা জানা যায়নি। রবীন্দ্র সাহিত্যে অনুল্লিখিত বাউলের নাম উকিল মুন্সি। যে উকিল মুন্সির জীবন-সাধনার সৃষ্টি তাঁর কালজয়ী গান। উকিল মুন্সিকেও ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে অরেকটি লেখায়। বাউল সাধক কানা খোরশেদ, জালাল উদ্দিন খানের ওপর পৃথক পৃথক দুটি লেখা রয়েছে। বাউল সাধক উকিল মুন্সির উত্তরসূরি কবি, গীতিকার, ছড়াকার, নাট্যকার ও শিক্ষক রইস মনরমের জীবন ও কর্মের বিষয়ে একটি লেখায় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। রাজনীতিবীদ হলেও হাওর অঞ্চলের দুই রবীন্দ্র অনুরাগীর ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ ও গোলাম এরশাদুর রহমান। এই দুই গুণী আর আমাদের মাঝে নেই। তাঁদের কর্মময় জীবনের অংশ বিশেষ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে পৃথক পৃথক দুটি লেখায়। বলে রাখা ভালো এই দুটি মানুষ রাজনীতিকে সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের ¯েœহধন্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের প্রতিরোধযোদ্ধা স্বপন চন্দ। অদ্ভুত তাঁর যাপিত জীবন। এই বইয়ে তাঁকে সম্মান জানিয়েও একটি লেখার চেষ্টা করেছি। সাংবাদিকতা আমার পেশা। সেইসঙ্গে আছে লেখালেখির অভ্যাস। এ দুয়ের মাঝখানে যা আমাকে খুব ভাবায় বা তাগিদ দেয় তা হলো ব্যক্তি হিসেবে দায়। সেই দায় থেকে বিভিন্ন বিষয় বা বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ নিয়ে লেখার চেষ্টা করি। সে লেখা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে কি না সে সংশয় তো আছেই। তবে আন্তরিকতার কোনো অভাব থাকে না। বেশিরভাগ সময় চেষ্টা থাকে অনালোচিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখা। আমার সব সময় মনে হয়, যাঁরা মফস্বলে থাকেন তাঁদের কর্ম সেভাবে উঠে আসে না। এইসব মানুষের কাজ গুরুত্বপূর্ণ যেনেও তাঁদের নিয়ে আলোচনা করার মানসিকতা অনেকের থাকে না। ফলে বিশ্বায়ন তাদের ডাকে সারা দিলেও সে ডাক নগরে পৌঁছায় না, সে অন্য প্রসঙ্গ। বিভিন্ন দিবসে এবং বিভিন্ন বিষয়েও ওপর কিছু লেখা জমা হয়েছে। বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ। হঠাৎ মনে হলো এগুলোকে মোড়কবন্ধ করা যায়, বই আকারে প্রকাশ করা যায়। এতে নিজের সন্তুষ্টির পাশাপাশি পাঠকও একসঙ্গে অনেকগুলো লেখা পড়ার সুযোগ পাবে। বলে নেওয়া ভালো, এত সিরিয়াস আলোচনার করার মতো সিরিয়াস সাংবাদিক এখনো আমি নই। সিরিয়াস লেখকও নই। কিন্তু সিরিয়াস লেখক ও সাংবাদিক হওয়ার বাসনা নিজের ভেতর সব সময় উঁকি দেয়। সেই বাসনা থেকেই কাজ করে যাওয়া। কাজ করতে গিয়ে কিছু মানুষের জীবন আমাকে ভীষণ ভাবিয়েছে, ভাবাচ্ছে। এরকম কয়েকজন মানুষকে শ্রদ্ধা নিবেদনের চেষ্টা করেছি। বইটিতে বিশেষ মানুষ বিবেচনায় আগে দেওয়া বা পরে দেওয়াটা এমন পরিকল্পনা করে করা হয়নি, বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নামের সৌন্দর্যের কথা বিবেচনায় রেখে একটি লেখার শিরোনামের সঙ্গে মিল রেখে বইটির নামকরণ করা হয়েছে ‘মৌরাগের কবি এবং অন্যান্য’। বইটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করলে কাউকে নতুন কোনো চিন্তার সন্ধান দিবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নাই। তবে চিন্তায় নতুন কিছু উপাদান যুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। সামনের দিনে আরও ভালো কাজের সুবিধার্থে যেকোনো পর্যায়ের পাঠকের পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রত্যাশা করি। সবশেষে বইটি প্রকাশের ইচ্ছা পোষণের জন্য প্রকাশকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। মুহম্মদ আকবর