একজন লেখক কিংবা কবির মোহিত করার ক্ষমতা ছাড়া বাকি সবই নিরর্থক। স্টিভেনশনের এই কথা আমি প্রাণেমনে বিশ্বাস করি। একজন কবির পাঠকপ্রিয়তা নির্ভর করে লেখার সমৃদ্ধি ও পাঠককেআকৃষ্ট করার ক্ষমতার উপর। আজোব্দি জগতে যত কবি জাগরুক তাদের অধিকাংশই পাঠকপ্রিয়তায় শীর্ষে। আদি কবি বাল্মিকী, হোমার, ভার্জিল, দান্তে, শেকসপিয়র, মিল্টন, বোদলেয়ার, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, পাবলো নেরুদা, জীবনানন্দ, র্যাঁবো, জসীমউদ্দীন, নাজিম হিকমত, মাহমুদ দারবিশ, টিএস এলিয়ট, ডব্লিউ ইয়েটসÑকত কবি কত বিচিত্র তাদের ভাষা ও কাব্যরীতি। প্রত্যেকের নিজস্ব কাব্যভাষা, স্বকীয় স্বর। আমি যখন কোনো কবির গ্রন্থের ভূমিকা লিখি তখন কবিতা মনোযোগ দিয়ে পড়ি। কবির অন্তর্গত জগৎ আবিষ্কার করার চেষ্টা করি। একুশের বইমেলার জন্য অনেক কবিতার বই হাতে আসে কিন্তু মানসম্পন্ন কবিতার বই খুব কম পাওয়া যায়। এবার বইমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে এ কে এম মাহবুব-উল ইসলামের কবিতার বই ‘ভাবনাহীন প্রেম’। মাহবুব ইসলামের কবিতার শব্দবন্ধ, কাঠামোগত উৎকর্ষ যথেষ্ট চৌকস। মূলত একটা জীবনবেদ, নানা জিজ্ঞাসা ও দর্শন ভাবনা তাকে জারিত করে। আধুনিক পৃথিবীর উৎকণ্ঠা, ক্ষত ও মানব বৈষম্য কবিকে স্পৃষ্ট করে। তিনি জানতে চান জীবন ও জগৎ, প্রেম ও মৃত্যু সমার্থক কিনা? প্রতিটি কবির হৃদয়ে নানা জিজ্ঞাসা থাকে। মাহবুব ইসলামের কবিতায় প্রবল জীবন জিজ্ঞাসা আছে। দুই নয়নের প্রিয় দিগন্ত, চাহিদার ঘুণে ধরা দুর্গটি আয়নার কাছে প্রশ্ন রাখে রতœ সম্ভার প্রয়াস অভিসার আর কতদূর নীলাম্বর জগত? নয়ন অর্থাৎ চোখ হয়ে উঠেছে দিগন্ত। নিলাম্বর জগতের সন্ধান কোথায়? আদৌ নিলাম্বর জগৎ কি আছে? থাক বা নাই থাক কবির কাজ নিজ মনোভূমে সেই কাক্সিক্ষত জগতের প্রতিষ্ঠা দেয়া। এই প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে তিনি শব্দের সেতু পার হন। কোলরিজ মনে করতেন ইবংঃ ড়িৎফং রহ ঃযব নবংঃ ড়ৎফবৎ. নির্বাচিত শব্দের শ্রেষ্ঠ বিন্যাস। এই কবির মধ্যে শব্দের উন্নতি পক্ষপাত লক্ষ্য করি। তৎসম-তদ্ভব শব্দের প্রতি প্রবল ঝোঁক। কিন্তু খাঁটি দেশি শব্দের দিকেও তার পক্ষপাত আছে। গর্ত, মোচড়, ছোবল। ‘নগ্ন হাসি’ কবিতার চারটি লাইনÑ রক্ত অন্বেষণে ঘুরে একদল রক্তপিপাসু মাটি ও মানুষের কাছে প্রতারণা করে নিত্য-নিয়ত, নিষ্ঠুর, নির্দয়, নির্মমতায়। বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাস রক্তের। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লেখনি ধারণ করার আন্তরিক এষণা কবিকে অনেক দূর দেখতে সাহায্য করে। আমাদের চারদিকে যে অনাচার বৈষম্য ও দুর্বলের প্রতি সবলের পীড়ন তা থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে সংগ্রাম। কবি সংগ্রামের উৎসে প্রেরণাদাতা। কবি হাঁটতে চান অনেক দূর। তিনি তার স্বপ্নের দুয়ার খোলা রাখতে চান। বলছেন : স্মৃতির দুয়ারে হানা দিয়েছে বিস্মৃতি এ কেমন অভিমান ছন্দহীন যাত্রা বিরতি! কবি ছন্দহীন যাত্রাবিরতিতে বিশ্বাস করেন না। তার হৃদয় ‘আজন্ম লালিত ললিতকলা শিহরণে অতৃপ্ত’। কবি মাহবুব ইসলাম অতৃপ্ত বলেই কবিতার ভুবনে তিনি চিরপথিক। আমি তার মঙ্গলময় কাব্যযাত্রায় অনুপ্রেরণা দিতে চাই। পাঠক নিশ্চয় এই কবির কবিতা পাঠে আনন্দিত হবে। বইটির বহুল প্রচার প্রত্যাশা করি। রেজাউদ্দিন স্টালিন