সত্তর-আশি দশকে ছোট গল্প লেখা হতো সংবাদপত্র উপলক্ষ্য করে। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা ছিল সমকালীন ছোটগল্পের আঁতুড় ঘর। দৈনিক বাংলা, সংবাদ, ইত্তেফাক, পূর্বদেশ, গণকণ্ঠ, জনপদ; সিনে সাপ্তাহিক চিত্রালী, পূর্বাণীঃ সাপ্তাহিক বিচিত্রা, রোববার, পূর্ণিমা, সচিত্র সন্ধানী আলোচ্য সময়ের ছোটগল্প ও গল্পকারদের ধারণ করেছিল। এ-সময়ের অন্যতম প্রতিনিধি কথাসাহিত্যিক সিরাজুল ইসলামের সময়ের চৌদ্দটি ছোটগল্প নিয়ে বর্তমান ছোটগল্প সংকলন- 'আজ সকালে'। সংকলিত গল্পগুলোর নাম এবং পত্রিকায় প্রকাশকাল : আজ সকালে (১৯৭৯), ঢেউ (১৯৯১), বন্ধন (১৯৮৬), গহনে (১৯৮৩), ভালুক, তার নাচটাচ (১৯৭৩), শত্রু (১৯৭৩), বনফুল (১৯৮৫), দূরের খেলা (১৯৮৪), যত দূরেই যাই (১৯৭৭), হলুদ বসন্ত (১৯৯১), এ সংসার (১৯৯১), পেখম (১৯৮৮), কেউ ডাকেনি (১৯৭৯), ভুল সত্য (১৯৭৬)। এ-সমস্ত গল্পের লিখন প্রক্রিয়া এবং সংবাদ পত্রের চলতি সময়ের সংবাদ প্রচারের পাশাপাশি প্রকাশ থেকে ধারণা হয় সংবাদ ও সাহিত্য হাত ধরাধরি করে চলেছে। সাহিত্যের কাজ সময়কে ধারণ করা। 'আজ সকালে গল্পগ্রন্থের চৌদ্দটি গল্প মুক্তিযুদ্ধের পরের দুই/তিন দশকের নাগরিক মধ্যবিত্তের বিশেষ করে যুবক-যুবতিদের মনন ও আত্মাকে ধারণ করেছে। গল্পগ্রন্থের নাম গল্পটি সম্প্রতি ফেসবুকে পোস্ট করা হলে কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গল্পটি পড়ে মন্তব্য করেন, “সেই সত্তরের দশকে এরকম শক্তিশালী একটা গল্প লিখলেন, আমি দেশে ছিলাম না। বলে পড়া হয়নি। অন্তত এখন পড়ছি, এটুকু সান্ত্বনা"। সময়ের সাক্ষী হয়ে থাকুক 'আজ সকালে' ও এই গ্রন্থে সংকলিত অন্যান্য গল্পগুলো।
সিরাজুল ইসলাম জন্ম ১৪ জুন ১৯৫১ সালে নারিন্দা, ঢাকায়। ষাটের ঢাকা এবং উৎকণ্ঠিত এক জায়মান সমাজবীক্ষা এই লেখকের ধমনিতে হয়তাে নিজের অজান্তেই জন্ম দিয়েছিল ভিন্ন এক শিল্পচেতনা, যা তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলাে বহন করে চলেছে! লেখালেখিসহ সামাজিক বিভিন্ন পরীক্ষাপ্রবণ সময়ে সিরাজুল ইসলাম উপন্যাস লেখেন প্রথাবদ্ধ নিয়মে, কথাসাহিত্যের ঐতিহ্য মেনে। কিন্তু নিয়ম মানাও যে নতুন নিয়ম গড়ার আঁতুড়ঘর হতে পারে, সিরাজুল ইসলামের লেখা তা পাঠককে অতি মৃদুকণ্ঠে নিয়ত জানিয়ে দেয়! পলাতকা, অশেষ, সিংহাসন, সােনার আলােয়, পাথরগুলাে, ছত্রাক, কুশীলব, হৃদয়, প্রিয়তম, টাপুর টুপুর লেখকের প্রকাশিত অন্যান্য উপন্যাস। সিরাজুল ইসলামের প্রায় সব গল্প বা উপন্যাসের বেশিরভাগ উপাদান শহরজীবনের বেদনাক্রান্ত জটিল; কিন্তু অতি সূক্ষ্ম মানবিক ক্ষরণের কথা। সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রায়ই শিল্পমূর্তি ধারণ করে সেই অন্তর্গত দ্বন্দ্বদীর্ণ ও রক্তিম ক্ষরণগুলাে! প্রায় প্রতিটি লেখাই নিজের অভিজ্ঞতা-সংহত; কিন্তু মধ্যবিত্ত মূল্যবােধ দ্বারা জারিত, কখনাে কখনাে একটু বিস্ফোরণের আভায় জড়ানােও। মধ্যবিত্ত বাঙালির গণ্ডির ভেতর ও বাইরের ক্ষীণ সীমারেখায় দাঁড়িয়ে মানব-মানবীর মনােজগতের অজানা প্রদেশের নিত্য খোঁড়াখুঁড়ি সিরাজের বিরামহীন এক প্রয়াস! পরিবেশের কুৎসিত বীভৎসতা বা ইতরতার মধ্যেও সিরাজের অন্বেষণ ও অন্বিষ্ট মানবিক হৃদয়ের ছবি আঁকা! সিরাজের গল্প বা উপন্যাস ভাবালুতাবর্জিত; কিন্তু ভাবনা উদ্রেককারী । মানবের অদম্য প্রাণশক্তির জয়ই সকল বেদনা বা সংগ্রামের মধ্যে বিভিন্ন শব্দের জাদুতে আঁকেন তিনি।