কবিতা ও গানের সম্মিলিত রূপই হলো কবিগান-এ কথা বললে হয়তো একটা সংজ্ঞা তৈরি হয় কিন্তু কবিগানের বিপুল বৈভব-বিস্তার-বৈচিত্র্যের অনেক কিছুই অজানা রয়ে যায়। বাঙালির লোকায়ত সংস্কৃতিবোধ থেকে জাত এই কবিগান গত প্রায় তিনশ বছর নানা উত্থান-পতনের ভিতর দিয়ে তৈরি করেছে এক গৌরবময় ঐতিহ্য। গোঁজলা গুঁই থেকে শুরু করে রাম বসু, ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, তারকচন্দ্র সরকার, হরিবর সরকার, মনোহর সরকার, রাজেন্দ্রনাথ সরকার, নকুলেশ্বর সরকার, রমেশ শীল, বিজয় সরকার হয়ে আজকের দিন পর্যন্ত এটি আমাদের সংস্কৃতির একটি বহমান ধারা। যদিও উনিশ শতকের কলকাতার বাবু-সংস্কৃতির পাল্লায় পড়ে কিছুকালের জন্য কবিগান খিস্তি-খেউড়ে পর্যবসিত হয় এবং অশ্লীলতাদুষ্ট হওয়ায় এমনকি রবীন্দ্রনাথ দ্বারাও তিরস্কৃত হয়, কিন্তু পরবর্তীকালে এই কবিগানই হয়ে উঠেছে মানুষের অধিকার, মুক্তির সংগ্রাম, সাম্যবাদ ও সমাজচেতনার এক জনপ্রিয় লোকায়ত মাধ্যম। অখণ্ড বাংলার বৃহৎ অঞ্চলজুড়ে এর বিস্তৃতি-বৈচিত্র্য প্রমাণ করে যে, কবিগানের রস বাঙালিকে বেশ মজিয়েছিল। গ্রন্থটিতে গবেষক ড. ইয়াসমিন আরা সাথী কবিগানের উৎপত্তি, বিকাশ-বিস্তার, এর জটিল আঙ্গিক, সমাজ, শিল্প ও সংস্কৃতি-মূল্য এবং এ ধারার কবি-শিল্পীদের সৃষ্টি ও অবদান সম্পর্কে সুবিস্তৃত আলোচনা করেছেন। এছাড়া কবিগানে পুরাণ প্রয়োগের কলাকৌশল এবং রূপবৈচিত্র্যকেন্দ্রিক ভাবনাও যুগপৎভাবে এসেছে। উল্লেখ করা জরুরি, এটি তাঁর পোস্ট-ডক্টরাল থিসিস হলেও কাজটি নিছক একাডেমিক বৃত্তে আবদ্ধ থাকেনি। বরং তিনি পারিবারিকভাবেও বৃহৎ কুষ্টিয়া-ভূগোলের সাংস্কৃতিক-সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যসন্তান হওয়ায় তাঁর ভূমিকা যুগপৎ অনুসন্ধানী ও রসগ্রাহী। ফলে এর ভাষা ও বয়ন আন্তরিক, হৃদয়গ্রাহী ও সুগভীর। পাঠক হিসেবে এই বইটি থেকে আমার প্রাপ্তি প্রচুর এবং বিশ্বাস করি, কলারসিক পাঠকরাও আমার সঙ্গে একমত হবেন। সৈকত হাবিব কবি