ওই নাটকে, আমাকে জেল থেকে ছাড়াতে বাকের ভাই নিজে ধরা দিয়ে জেলে গেলেন, কারণ সামনে আমার বিয়ে। ব্যস, অফিসে আমার নাম হয়ে গেল বিয়ে-পাগলা। এখন সামনাসামনি তো কেউ কিছু বলতে পারে না, আমি তাদের বড়কর্তা, কিন্তু আমি তাদের চোখমুখে বিদ্রুপটা স্পষ্ট পড়তে পারি। তারা বাস্তবতা গুলিয়ে ফেলে। আমি যে বহু আগে থেকেই বিবাহিত, আমার ছেলেমেয়েদেরও বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, এসব তারা জানে, তারপরও তারা আমাকে বিয়েপাগলা ভেবে বিদ্রুপ করছে - এই লোকটা বিয়ে করবে বলে বাকের ভাইকে জেলে যেতে হলো... কোনও মানে হয়! ‘তারপর সেই বিয়ের দৃশ্যে কী হলো শোনো। হুমায়ূন ভাই তো পাগলা ছিলেন। সঙ্গে বরকতউল্লাহ্ ভাই আরেক পাগলা। তারা করলেন কি, একটা কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করে সত্যি সত্যিই বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করে ফেললেন। একেবারে বাবুর্চি ডেকে দেড়শো লোকের খানাদানা, ঘোড়ার গাড়িতে বরযাত্রী, ব্যান্ডপার্টি সবকিছু। এখন কমিউনিটি সেন্টারের বিয়েতে জানোই তো, কিছু ফাউ পার্টি থাকে, কাউকে বলে বরপক্ষ, কাউকে বলে কনেপক্ষ; তো সেই বিয়েতেও এইরকম একদল জুটে গেল। এখন শুটিংয়ের প্রডাকশন ম্যানেজার, প্রডাকশন বয় এরা কী চিজ, জানোই তো! তারা তো ধরে ফেললো, আর ওরাও বলাবলি করছে বরপক্ষ কনেপক্ষ। যখন জিজ্ঞেস করা হলো, বরটা কে? আর বলতে পারে না। আমি তখন সামনে গিয়ে বললাম, এই যে আমি বর! তারা তো হতভম্ব! পাশে আবার আমার স্ত্রীও দাঁড়িয়ে। নাটকের স্ত্রী না, আসল স্ত্রী! লোকজন কী করবে, কী বলবে, ভেবে পাচ্ছে না। ... আবার ধরো, শুটিংয়ে তো প্রচুর সময় লাগে, জানোই। লাইট করতেই দেড় দুই ঘণ্টা। আমার লেগেছে খিদে। আমি করলাম কি, সবার চোখ এড়িয়ে চলে গেলাম রান্নার জায়গায়। বাবুর্চি আমাকে ওখানেই প্লেটে খাবার বেড়ে দিলো, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে লাগলাম। আমি ভেবেছি, কেউ দেখবে না, কিন্তু দেখে ফেললেন হুমায়ূন ভাই। উনি করলেন কি, ওইখানেই ক্যামেরা সেট করে ফেললেন! তাৎক্ষণিকভাবে স্ক্রিপ্ট বদলে সেই দৃশ্যটা ধারণ করা হলো। ... এবং ওই পর্ব প্রচারিত হওয়ার পর যথারীতি অফিসে তা নিয়ে আরেকপ্রস্থ হাসাহাসি, বিদ্রæপও!’ ‘তারপর? মানে মিথ্যা স্বাক্ষী দেয়ার পর?’ ‘ওইটাই তো মেইন কোর্স। এইগুলো ছিলো স্টার্টার। কী হয়েছে শোনো। আমার সহকারী, আমাকে চা-নাস্তা দেন যে লোকটি। অন্তত ১২ বছর ধরে চেনেন আমাকে। সেই লোকটি পর্যন্ত চা দেয়ার ফাঁকে বলেই ফেললেন, আপনি এইটা করতে পারলেন স্যার? আপনাকে এত ভালো মানুষ জানতাম, আর আপনি...! আমি তাকে বললাম, আরে বাবা, ওটা তো নাটকের দৃশ্য। বাস্তব কিছু তো না। নাট্যকার যেভাবে লিখেছেন, সেভাবেই তো অভিনয় করতে হবে। হুমায়ূন ভাই লিখেছেন... আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো, হুমায়ূন স্যার বললেই আপনাকেও বেঈমানি করতে হবে? আপনেরে হুমায়ূন আহমেদ খাওয়ায় না বাকের ভাই খাওয়ায়? আপনের বিয়ার জন্য জেলে কে গেছে? হুমায়ূন ভাই না বাকের ভাই? আপনে হুমায়ূন ভাইয়ের কথায় তারে ফাঁসায়ে দিলেন? তারে যদি এখন ফাঁসি দিয়া দেয়, আপনি বাঁচাইতে পারবেন?’ এতটুকু বলে কাদের ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! কিছুই বলতে পারলাম না। কাদের ভাই যেন বিজয়ীর বেশে হা হা করে হেসে উঠলেন। বাকের ভাইয়ের ফাঁসির প্রতিবাদে ঢাকার রাস্তায় মিছিল হয়েছিলো, প্রেসক্লাবে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছিলো, আমরণ অনশনের হুমকি দিয়েছিলো একদল ভক্ত। কিন্তু এইভাবে, কাদের ভাইয়ের দীর্ঘদিনের সহকর্মী যে সত্য-মিথ্যার দোলাচলে বিমূঢ় হয়ে যাবেন, পর্দার বাস্তব আর বাস্তবের বাস্তবকে গুলিয়ে ফেলবেন, আব্দুল কাদেরের অফিস সহকারী হয়ে বদিকে গালমন্দ করবেন, এতটা আমারও ধারণায় ছিলো না। আমি কোনও কথা খুঁজে পেলাম না। কাদের ভাই হাসতে হাসতে বললেন, ‘সাধেই কি আর বললাম, আমি মানুষের ভালোবাসা নয়, ঘৃণা অর্জন করেছি।’ সত্যিই তাই। আমার মনে পড়লো, কোথায় যেন শুনেছিলাম, সিনেমায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রের অভিনেতা আনোয়ার হোসেন একবার কোথাও একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছেন প্রধান অতিথি হয়ে। তো, সেই অনুষ্ঠানে নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটকের মঞ্চায়ন হচ্ছে। নাটকের এক পর্যায়ে মীরজাফর চরিত্রের বেঈমানির দৃশ্য চলাকালে আনোয়ার হোসেন বাস্তবতা ভুলে গিয়ে স্টেজে উঠে সেই অভিনেতাকে জুতাপেটা করতে থাকেন আর চিৎকার করে বলতে থাকেন, এত বড় বেঈমানি? এত বড় ষড়যন্ত্র? বাংলার স্বাধীনতার সাথে বেঈমানি? বাংলার মানুষের সাথে প্রতারণা? হলভর্তি দর্শক হতভম্ব হয়ে যায়, আর সেই অভিনেতা তাঁর পায়ে পড়ে যান আশীর্বাদ নিতে, তখনই কেবল তিনি বাস্তবে ফিরে আসেন। Ñ এই গল্প কিংবদন্তীর মতো ছড়িয়ে আছে বাংলার ঘরে ঘরে, সত্য কি মিথ্যা জানি না। কিন্তু বদি চরিত্রের অভিনেতা আব্দুল কাদেরের এই ঘটনা তো কিংবদন্তী নয়, যা সত্য হতে পারে, নাও পারে। তাঁর নিজ মুখ থেকে শোনা নির্জলা সত্য কাহিনী! আব্দুল কাদের বললেন, ‘এই যে বাকের ভাইয়ের এমন তুমুল জনপ্রিয়তা, এবং সে কারণেই বদির প্রতি এত ঘৃণা, আশ্চর্য ব্যাপার কি জানো? আমি কাদেরও কিন্তু বদিকে ঘৃণা করি! নিজের অজান্তেই করি।’