সকালে ঘুম থেকে উঠে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম জানালা দিয়ে কে যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দিকে চোখে পড়তেই আমি চমকে উঠলাম। আমাকে চমকে উঠতে দেখে সে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসলো। আমি তাড়াতাড়ি বিছানায় উঠে বসলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে তীক্ষ্ণগলায় জিজ্ঞেস করলাম, কে আপনি? জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা আমার কথার কোনো উত্তর দিলো না। আবার দাঁত বের করে হাসলো। হাসার সময় লক্ষ্য করলাম পান খেতে খেতে লোকটার দাঁত তরমুজের বিচির মতো কালো হয়ে গেছে। জানালার পাল্লা সামান্য ফাঁক করে সে দাঁড়িয়ে ছিলো। বিছানায় বসে থেকেই আমি জানালার পাল্লাগুলো মেলে দিলাম। মুহূর্তেই অন্ধকার ঘর আলোকিত হয়ে উঠলো। আমাকে জানালার পাল্লা খুলতে দেখে সে জানালার সামনে থেকে সরে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। লোকটার গালে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। পরনে একটা লুঙ্গি আর কোমরে একটা হলুদ রঙের গামছা বাঁধা। তার গায়ে কিছু নেই। সূর্যের আলো পড়ে সারা গা চিকচিক করছে। চঞ্চল চোখে সে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার উঠানের পাশের নিরীহ পথের দিকে তাকাচ্ছে। তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। সে কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি চলে যাবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
আমি ইবরাহীম ওবায়েদ। বিশ শতকের শেষ দশকে পুরনো ঢাকার আবদুল হামিদ লেনে আমার জন্ম। দিনটি ছিলো রবিবার, ২৯ শে আগস্ট ১৯৯৩। আমার ছেলেবেলা কেটেছে পুরনো ঢাকায়। সেখানেই বেড়ে উঠেছি। ঢাকা শহরের আয়তন এখন অনেক বেড়েছে। কিন্তু ইতিহাসে মূলত এই পুরনো ঢাকাকেই বলা হয় বায়ান্ন বাজার তেপান্ন গলির শহর। প্রাচ্যের রহস্য নগরী। যার প্রতিটি ধূলিকণায় বৈচিত্র্য ছড়িয়ে আছে। এখানকার মানুষের ভাষা এবং জীবনধারা আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করে। শহরের পাশেই বিখ্যাত বুড়িগঙ্গা নদী। ছোটোবেলায় এই নদীর যেই জৌলুস দেখেছিলাম এখন আর তা নেই। অথচ আজও এই নদী আমার জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। এখনো বুড়িগঙ্গায় ঢেউ ওঠে। বুড়িগঙ্গার প্রতিটি ঢেউ যেন আমাকে নতুনভাবে স্বপ্ন দেখার অনুপ্রেরণা জোগায়। এখনকার মাটি, মানুষ ও সংস্কৃতি আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। এখানকার রূপ, রস, গন্ধ আমার নিঃশ্বাসকে সজীব করে তোলে। অসংখ্যবার এমন হয়েছে, রিক্সায় করে অথবা হেঁটে কোথাও যাচ্ছি, নাজিরা বাজার মোড়ে এসে বিরিয়ানির মাতাল ঘ্রাণে রিক্সা থেকে নেমে ঢুকে পড়েছি বিখ্যাত কোনো একটা বিরিয়ানির দোকানে। তৃপ্তি সহকারে ভোজন সেরে আবার যাত্রা করেছি। বাংলাদেশ তো বটেই—বিশ্বের আর কোথাও এমন একটি শহর নেই, এমন একটি বৈচিত্র্যময় পুরনো ঢাকা নেই! এই শহরটাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। এই দেশের কাছে আমার যেমন অনেক ঋণ আছে তেমনি এই শহরের কাছেও আমি অনেক ঋণী। আমি ঘুরতে ভালোবাসি। প্রাণীদের মধ্যে বিড়াল আমার খুব প্রিয়। প্রকৃতি, পাহাড় এবং সমুদ্র আমাকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে। অনন্ত আকাশের বিশালতা আমার হৃদয়ে অদ্ভুত এক ধরনের আকুলতা তৈরি করে। মাঝে মাঝে মনে হয় শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই গোটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়! একাকিত্ব খুব ভালো লাগে কিন্তু নিঃসঙ্গতা আমার খুবই অপ্রিয়। আমি জগতটাকে যেভাবে দেখি এবং অনুভব করি সেটাই লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি। বাংলা সাহিত্যের একজন দীন সেবক হিসেবে এটাই আমার তৃপ্তি এবং সার্থকতা।