কোন্ কবিতাটি শ্রেষ্ঠ এটা বলা দুরূহ। তবে এতদিনের কবিতাচর্চার অভিজ্ঞতা দিয়ে এটুকু বুঝি অনেকদিনের লেখা কোনো কবিতা পুনরায় পাঠ করলে যখন ভালো লাগে বুঝি কবিতাটি ভালো। জ্যাক দেরিদা কী এজন্য টেক্সটের পুনঃপাঠকে গুরুত্ব দিয়েছেন। স্পিভাক সবসময় কবিতা কিংবা কোনো লেখার দ্বিতীয়-তৃতীয়পাঠে বদলে যাওয়া অর্থকে বিবেচনায় নিয়েছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে তখন অতীতের লেখার ভাষাটা কতটা সমকালীন কিংবা প্রাসঙ্গিক তা বিবেচনায় আনা যায়। হেরাক্লিটাসের বিখ্যাত বাণীটি এখনও পাঠকের আদর্শ হতে পারে : এক নদীতে দুবার স্নান সম্ভব নয়। অর্থাৎ স্রোত বদলে যায়। এরকম গ্রন্থনদীর চলমানতা আমাদের নিয়ে যায় নতুন নতুন অর্থের দিকে। আমার লেখাগুলোর মধ্যে কোন্টি শ্রেষ্ঠ তা বিবেচনা করতে গিয়ে দেখেছিÑ আমার তারুণ্যে লেখা প্রথম ‘ফিরিনি অবাধ্য আমি’ কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা এখনও আগের মতো ভালো লাগছে। আবার সাম্প্রতিককালের অনেক কবিতা আর টানছে না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে লেখা কিছু কবিতা আমার বোধকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছে যে আমি আপ্লুত হয়েছি। তখন কবিতাটি আর আমার একার থাকেনি চিরকালের এবং সকলের হয়ে গেছে। ক্রোচে ভাবতেন লেখার সাথে পাঠকের মুখোমুখি সংঘর্ষ। ভালো মন্দের বিচারের সৎ স্বীকারোক্তি। উপনিবেশিক মানসিকতা অবদমিত করে রেখেছি দীর্ঘ ৩০০ বছর। নিজের মাতৃভাষাকেও আমরা সম্মান জানাতে কুণ্ঠিত। বাইরের যা কিছু সবই উৎকৃষ্ট। আমাদের লেখা তুচ্ছ-স্থূল এমন উন্নাসিক পাঠক ক্ষতিকর। ডিরোজিও প্রমুখরা যে রেনেসাঁসের জন্ম দিয়েছিল তার ছিটেফোঁটা আলো এখনও অনেক প্রাজ্ঞ পাঠককে মাতৃভাষা ও দেশ প্রেমে অটল রেখেছে আমি বিশ্বাস করি। এই গ্রন্থের এক-শো শ্রেষ্ঠ কবিতা আমার বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ। কিন্তু পাঠকের বিবেচনায় নাও হতে পারে। আমার শপাঁচেক কবিতার মধ্যে এক-শোটি নির্বাচন করেছি। এর মধ্যে কিছু কবিতা যদি পাঠক গ্রহণ করে আমি কৃতজ্ঞ হব। আমি বিশ্বাস করি কবিতা যতটা না অনুধাবনের তারচেয়ে বেশি অনুভবের। বাতাসের নির্মল প্রবাহ, পাহাড়ের উচ্চতা, আকাশের অসীমত্ব, নক্ষত্রের অজস্র প্রজ্বলন আমাকে যে অনুভবের জগতে নিয়ে যায় তা অনির্বচনীয়। তা অভ্যাসগত থাকে চিরদিন। এখানে ভাষার সীমাবদ্ধতা, এখানে কবিতা সসীম। তবে যে কবি অনুভবকে শব্দগ্রাহ্য করতে পেরেছে সে তত বড়ো, তত মহৎ। আমি মাইকেল মধূসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ কবিকে অনুভবের তাৎপর্য যথার্থ উপলব্ধি ও তার প্রকাশের পারঙ্গমতায় দক্ষ দেখেছি। শেষ কথা হলো, যত ভালো কবিতা বোধ্য হবে, হৃদয়ঙ্গমের সুযোগ থাকবে। রবীন্দ্রনাথ যখন উচ্চারণ করেনÑ ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ তখন এই বাক্যবন্ধ কী এক অজানা কথা আছে তা আমরা খুঁজতে থাকি। শেকসপিয়র যখন বলেন, To be or not be তখন আমরা এক দার্শনিক অসীম কোনো ধ্বনির মুখোমুখি হই। কিংবা ইউলিসিস সাইক্লোপসের শুহায় যখন বলেন, ও I am nobody তখনও আমরা আমাদের অস্তিত্ব ও তার শূন্যতাকে অনুভব করি। পৃথিবীর যে সব কবিতার মধ্যে বক্তৃতার অণু থাকে তা উত্তীর্ণ হয়। সব বড়ো কবিতার মধ্যে তা থাকে। প্রত্যেক কবির প্রথম লাইনটি যখন আসে তখন তা আর্কিমিডিসের সূত্রের মতো। এই পাওয়ার মুহূর্তটিকে আমরা এপিফেনি বলি। একজন পাঠকও যখন তার হৃদয়ের কথাটি পেয়ে যান তখন তার ঘটে এপিফোন। আমার শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে একটি কবিতাও যদি কোনো পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করতে পারে তাহলে আমার কবিতাচর্চা সার্থক বলে গণ্য হবে। জয় হোক কবির। জয় হোক কবিতার। রেজাউদ্দিন স্টালিন ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
জন্ম ২২ নভেম্বর ১৯৬২, বৃহত্তর যশোর জেলার নলভাঙা গ্রামে। পিতা শেখ বোরহানউদ্দিন আহমেদ। মাতা রেবেকা সুলতানা। কাব্যগ্রন্থ সংখ্যা ৪০, স্বকণ্ঠ আবৃত্তি ৩টি ক্যাসেট। প্রদীপ ঘোষের কণ্ঠে ‘আবার একদিন বৃষ্টি হবে’ শীর্ষক অ্যালবাম। রবীন্দ্রনাথ আরোগ্য, নির্বাসিত তারুণ্য, কাঠ কয়লায় লেখা, দিব্য চোখে দেখছি এবং ডাকঘর শিরোনামে প্রবন্ধগ্রন্থ। শিশুতোষ গ্রন্থ হাঁটতে থাকো, শৈশব এবং জলচাষি। সাক্ষাৎকার গ্রন্থ প্রশ্নের পুরাণ, একুশ প্রশ্ন এক উত্তর ও দুঃসময়ের ইউলিসিস। বইপড়া, সিনেমা দেখা, আড্ডা দেয়া এবং আরামপ্রদ ভ্রমণের শখ। দেখেছেন ভারতবর্ষ, আমেরিকা, নেপাল ও চীন। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমি, মাইকেল মধুসূদন, খুলনা রাইটার্স ক্লাব, ধারা সামাজিক সাংস্কৃতিক পুরস্কার, দার্জিলিং নাট্যচক্র পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গের সব্যসাচী পুরস্কার, রংপুর বজ্রকথা পুরস্কার, অগ্নিবীণা পুরস্কার, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন পুরস্কার। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি ও তরঙ্গ অফ ক্যালিফোর্নিয়া সম্মাননা, লসএঞ্জেলেস বাদাম সম্মাননাসহ আরো বহু পুরস্কার।