আমরা সচরাচর ভারতবর্ষের যেসব ইতিহাস পড়ি, তাহার ভিতর এই জাতির প্রাণের সাড়া পাই না। এইসব স্কুলপাঠ্য পুস্তকে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান ও ইংরাজ অধিকার, এই চারিটি যুগ একেবারে ভিন্ন ভিন্ন কোঠায় আবদ্ধ করিয়া দেখানো হয়, যেন একটিকে সংহার করিয়া তাহার সমস্ত চিহ্ন লোপ করিয়া তবে তৎপরবর্তী যুগ বা জাতি ভারতবর্ষ দখল করিয়াছে, পূর্ব ও পরের মধ্যে কোনই সম্বন্ধ নাই; আগেকার যুগের প্রভাব, আগেকার যুগের দান, যেন পরের যুগে চলিয়া আসে নাই, যেন এই ভারতীয় জাতি প্রত্যেক যুগের শেষে মরিয়া গিয়া আবার নূতন শিশু হইয়া জন্মিয়াছে। কিন্তু এইরূপ মনে করা ভুল। ইতিহাসের প্রকৃত শিক্ষা ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত। যুগে যুগে ভারতের সেই একটি প্রাণ, সেই একই জাতীয় বিশেষত্ব রাজারাজড়ার, ধর্ম ও ভাষার অসীম পরিবর্তনের মধ্য দিয়া সজীব থাকিয়া অগ্রসর হইয়াছে; বাহ্যবেশ বদলাইয়াছে বটে, কিন্তু মরে নাই, নিজ আত্মাকে হারায় নাই। সহস্র সহস্র বৎসরের শত শত রাজনৈতিক ও ধর্মসম্বন্ধীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়া ভারতীয় জনসঙ্ঘের (nationalityর) প্রাণ ও ব্যক্তিত্ব কিরূপে জীবন্ত থাকিয়া বাড়িয়া চলিয়াছে, প্রত্যেক যুগ হইতে, প্রত্যেক রাজার জাতি হইতে ভারতীয় জাতি কিরূপে দেহ ও চিত্তের পুষ্টিলাভ করিয়াছে, ভারতবর্ষ কিরূপে সেই যুগের দানগুলি নিজস্ব করিয়া পূর্ববর্তী যুগের দানগুলির সহিত তাহার সামঞ্জস্য করিয়া লইয়াছে এবং ইহার ফলে যে ভারতীয় জাতি আমরা আজ চোখের সম্মুখে দেখিতেছি, তাহা বর্তমান অবস্থায় কেমনে উপনীত হইয়াছে, এই জনসঙ্ঘের চরিত্রের বিশেষত্ব ও গুণ, সভ্যতা ও চিন্তার সেই ক্রমবিকাশ পদে পদে দেখানোই ইতিহাসের প্রকৃত কাজ।
স্যার যদুনাথ সরকারের (১০.১২.১৮৭০-১৯.৫.১৯৫৮) জন্ম রাজশাহী জেলার করচ মারিয়ায় । ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক । ইংরেজি ভাষায় লেখা তাঁর গবেষণা কর্মগুলি পণ্ডিত মহলে সমাদৃত। বাংলায়ও তিনি বহু সংখ্যক প্রবন্ধ লিখেছেন । ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধসমূহ তার মধ্যে অন্যতম । ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। হিসাবে যদুনাথ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিলেন । ভাষা ও সহিত্যেও তাঁর ছিল অগাধ জ্ঞান । ‘সমকালে প্রকাশিত বেশ কিছু বাংলা ইতিহাস গ্রন্থের যে আলােচনা তিনি করেছেন তার থেকে মাতৃভাষায় ইতিহাস চর্চার প্রসারে তার আগ্রহ ও উৎসাহ বােঝা যায়। জীবনের নানা দিকে অবারিত কৌতুহলের পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন দেখা যায় তার রচনায় ।। ১৮৯১ খ্রি. প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি ও ইতিহাসে অনার্স-সহ বি.এ. এবং ১৮৯২ খ্রি. ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে। এম.এ. পাশ করেন। ১৮৯৭ খ্রি. প্রেমৰ্চাদ রায়চঁাদ বৃত্তি পান। ১৮৯৮ খ্রি. প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৮৯৯ খ্রি. পাটনা কলেজে বদলি হয়ে ১৯২৬ খ্রি. পর্যন্ত সেখানে ছিলেন। মধ্যে কিছুকাল (১৯১৭-১৯ খ্রি.) কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে অধ্যাপনা করেন। অধ্যাপক জীবনে বেশিরভাগ সমময় কাটে পাটনা ও কটকে। ১৯১৯-২৩ খ্রি. কটক কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। ৪ আগস্ট ১৯২৬ খ্রি. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনিই প্রথম অধ্যাপক ভাইসচ্যান্সেলর ।।