প্রস্তাবনা এই লেখা ইতিহাস নয়। ভ্রমণ কাহিনিও নয়। একে সংক্ষিপ্ত একটি যাপিত জীবনের স্মৃতিকথা বললে বেশি বলা হবে না বলে আমার ধারণা। আমার এই স্মৃতিকালের শুরু ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে। শেষ ১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে। এক বছরের কিছু কম সময়। আমি তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত। পদবি ক্যাপ্টেন। আমার পর্যবেক্ষণ হলো যে, সেনাবাহিনীর পদমর্যাদাসমূহের মধ্যে এই পদটাই সবচেয়ে সুশোভিত। একই সাথে যৌবনদীপ্ত। আমার সেই যৌবন দিনে বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারের খেলা আমাকে টেনে গিয়েছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়। ইন্দোচীনের বিখ্যাত এক নদীর অববাহিকায়। সেই নদীর নাম মেকং। দেশের নাম কম্বোডিয়া বা কম্পুচিয়া। আমি সেখানে গিয়েছিলাম জাতিসংঘের সামরিক পর্যবেক্ষক বা মিলিটারি অবজার্ভার হিসেবে। জাতিসংঘের সেই মিশনটির নাম ছিল উনটাক (UNTAC)। ‘ইউনাইটেড নেশনস ট্রানজিশনাল অথরিটি ইন কম্বোডিয়া’। বাংলায় কম্বোডিয়ায় জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষ। মিশনটি ছিল এক শান্তিপ্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। ১৯৯০ দশকে জাতিসংঘ কর্তৃক এই শান্তি মিশন পরিচালিত হয়েছিল। তৎকালীন পৃথিবীতে জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় অভিযান। পূর্ণ সাফল্য অর্জন না করতে না পারলেও এই মিশনেরই ফলাফল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শান্তিপূর্ণ অবস্থান। উন্নয়নও। তিব্বতের মালভূমি থেকে এশিয়ার যে কয়েকটি মহানদী সমতলে নেমে এসেছে তাদের মধ্যে মেকং অন্যতম। সাগরের সাথে মহামিলনের তীর্থযাত্রায় এই নদী কয়েকটি দেশ (চীন, মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম) অতিক্রম করে চীন সাগরে পতিত হয়েছে। ৪২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ যাত্রাপথে সে দক্ষিণ এশিয়ার সমগ্র মধ্যাঞ্চলকে প্লাবিত করে সমৃদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয়। বলা যেতে পারে, কেবল মেকং নদী দিয়েই ইন্দোচীনের সকল দেশগুলোকে বিনিসুঁতোর মালায় গেঁথে ফেলা সম্ভব। আদিকাল থেকে এই নদীর তীরবর্তী অববাহিকার দেশগুলোতে গড়ে উঠেছিল নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা। এগুলোকে কেন্দ্র করেই বর্তমান পর্যন্ত আবর্তিত হয়েছে এই অঞ্চলের ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদ, ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের লড়াই, জনমানুষের প্রতিরোধ, সংগ্রাম ও বিপ্লব। এমনকি উত্থান-পতনও। সংক্ষেপে বলি। মেকং নদীর পাড়ের দেশ কম্বোডিয়া। রাজধানীর নাম নমপেন। ১৯৭৫ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখে ইতিহাসের কুখ্যাত নেতা পলপট কম্বোডিয়া দখল করে। তার নেতৃত্বে লক্ষ লক্ষ কমিউনিস্ট খেমাররুজ গেরিলা নমপেন শহরে প্রবেশ করে। তারপর ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে পরিচালনা করে নানাবিধ সংস্কার ও শুদ্ধি অভিযান। সাথে নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞ বা গণহত্যা। এই গণহত্যায় ৩০ লক্ষ কম্বোডীয় জনগণ মৃত্যুবরণ করে। এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৯২-৯৩ সনে পরিচালিত হয়েছিল জাতিসংঘের অধীনে এই শান্তিরক্ষা মিশন তথা শান্তি অভিযান।