সান্টিয়াগো যখন ছোট ভাঙাচুরা চার্চে গিয়ে পৌঁছালো তখন রাত নেমে আসছে। স্যাকরিস্টির মাঝে সাইকোমোর গাছটা দাঁড়িয়ে আছে, চালের ফুটো দিয়ে তারাগুলোকে এখনো দেখা যাচ্ছে। তার মনে পড়লো সে যখন ভেড়াদের নিয়ে এখানে রাত কাটাতো তখন রাতগুলো নির্বিঘেœই কাটতো শুধু স্বপ্ন দেখলে একটু অন্যরকম হতো। এখন ভেড়ারা সান্টিয়াগোর সাথে নেই, তার সাথে আছে একটা শাবল। সান্টিয়াগো বহুক্ষণ ধরে তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার ঝুলি থেকে মদের বোতল বের করে কিছুটা পান করলো। আলকেমিস্ট ও সে এমনি ভাবে তারা দেখেছিলো এবং মদ পান করেছিলো। যতো পথ সে ভ্রমণ করেছে এবং গুপ্তধন আবিষ্কার করতে ঈশ্বর যতো অদ্ভুত জিনিসের সাথে তার পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছেন তার কথা মনে পড়লো। যদি সে দ্বৈত স্বপ্ন না দেখতো তাহলে জিপসি বুড়ি, রাজা, চোর অথবা... ‘আসলে একটা লম্বা তালিকা। কিন্তু ভাগ্য যেমনভাবে তার পথ সাজিয়ে দিয়েছে যে তাতে ভুল হবার সম্ভাবনা ছিলোই না’, সে নিজেকে নিজে বললো। সান্টিয়াগোর যখন ঘুম ভাঙলো তখন সূর্যটা বেশ উপরে উঠে গেছে। সে সাইকোমোরের গোড়া খুঁড়তে লাগলো। তুমি প্রাচীন সরসিরার। তুমি আমার সমস্ত ঘটনা জানো। তুমি আমার জন্য কিছুটা সোনা সেই মনেসটারিতে রেখে দিয়েছিলে যাতে করে আমি চার্চে ফিরে আসতে পারি। সন্ন্যাসী আমার জীর্ণ অবস্থা দেখে হেসেছিলো। কিন্তু তুমি কী আমাকে রক্ষা করোনি? না, আমি যদি তোমাকে বলতাম তাহলে তুমি পিরামিড দেখতে যেতে না। কিন্তু তারা কি সুন্দর না দেখতে? সান্টিয়াগো এই কথাগুলো বাতাসে শুনতে পেলো। সে হাসতে লাগলো আর খুঁড়তে লাগলো। আধঘণ্টা পর তার শাবলটা একটা শক্ত জিনিসে সাথে আঘাত খেলো। এক ঘণ্টা পরে সে একটা সিন্দুক দেখতে পেলো যার মধ্যে স্প্যানিশ স্বর্ণমুদ্রা আছে। আছে মূল্যবান পাথর, সোনার মুখোশ, রক্তাভ পালক বসানো রতœখচিত বিভিন্ন মূর্তি। রাজ্য বিজয়ের ফলে সঞ্চিত গুপ্তধনের কথা মানুষ মনে রাখেনি এবং বিজয়ীরা তাদের সন্তানদের এ কথা বলতে ভুলে গেছে। সান্টিয়াগো ইউরিম এবং থামমিম পাথর দুটো তার ব্যাগ থেকে বের করে আনলো। তারাও এখন তার বর্তমান গুপ্তধনের অংশ, এ দুটো এখন বুড়ো রাজার স্মৃতিস্বরূপ, সে কখনোই তাদের ভুলবে না। সান্টিয়াগো ভাবলো, কথাটা ঠিক। জীবন তাদের কাছে উদার যারা তাদের ভাগ্যকে অনুসন্ধান করে। সান্টিয়াগোর মনে হলো তার তারিফাতে যেতে হবে যেখানে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তার গুপ্তধনের দশ ভাগের একভাগ জিপসি বুড়িকে দিতে হবে। জিপসিরা আসলেই জ্ঞানী, তার কারণ তারা প্রচুর ভ্রমণ করে। বাতাস আবার বইতে লাগলো। ল্যাভেন্ডার আফ্রিকা থেকে এসেছে। মরুভূমির গন্ধ বা মুরিস আক্রমণের ভীতি বয়ে আনেনি। পরিবর্তে এনেছে এমনি একটা সুগন্ধ যা সে ভালো করে জানে, এবং চুম্বনের স্পর্শ, যা বহুদূর থেকে আস্তে আস্তে করে তার ঠোঁটের উপর চেপে বসেছে। সান্টিয়াগো হাসলো। এটাই প্রথম সে যা করেছে—ফাতিমা, আমি আসছি...
ব্রাজিলিয়ান ঔপন্যাসিক পাওলো কোয়েলহো ডি’সুজা ১৯৪৭ সালের ২৪ আগস্ট দেশটির রাজধানী রিও ডি জেনেরিওতে জন্মগ্রহণ করেন। একই শহরে তার শিক্ষাজীবনের শুরু এবং বেড়ে ওঠা। আইন বিষয়ে কিছুদিন পড়াশোনার পর ভ্রমণের নেশায় তা আর শেষ করতে পারেননি। ঐ সময়টা ভবঘুরের ন্যায় ঘুরে বেড়িয়েছেন মেক্সিকো, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, চিলিসহ ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে। এর পরপরই ছোটবেলার স্বপ্ন বই লেখাকে বাস্তবে রূপ দেন। ১৯৮২ সালে ‘হেল আর্কাইভস’ নামক বই দ্বারা সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ করেন। তবে এই প্রবেশ আকর্ষণীয় ছিলো না। এমনকি দ্বিতীয় প্রকাশিত বই ‘প্রাক্টিক্যাল ম্যানুয়েল অব ভ্যাম্পায়ারিজম’ তার নিজেরই অপছন্দের তালিকায় ছিলো। ১৯৮৭ সালে ‘পিলগ্রিমেজ’ এর পর ১৯৮৮ সালে প্রকাশ পায় তার আরেক বই ‘দ্য আলকেমিস্ট’। পাওলো কোয়েলহো এর বই হিসেবে ‘দ্য আলকেমিস্ট’ বইটিই মূলত কোয়েলহোর লেখক-জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তবে ‘৮৭ সালে বইটি প্রকাশিত হয়েছিলো ব্রাজিলের একটি ছোট প্রকাশনা সংস্থা থেকে, যারা ন’শোর বেশি কপি ছাপাতে নারাজ ছিলো। ১৯৯৩ সালে একই বই আমেরিকার বিখ্যাত প্রকাশনী হারপার কলিন্স থেকে প্রকাশিত হলে পাঠক মহলে হুলুস্থুল পড়ে যায়। বইটি এখন পর্যন্ত মোট ৮০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, যা পাওলো কোয়েলহো এর বই সমূহ এর মাঝে অনন্য। কোয়েলহোর কাহিনীগুলোর বিশেষত্ব হলো তার কল্পনাশক্তির জাদুকরী মোহ। কোনো সরল গল্প দ্বারা তিনি গভীর জীবন দর্শনবোধ পাঠকদের মাঝে সঞ্চালন করতে চান, এবং সফলতার সাথে করেও এসেছেন। পাওলো কোয়েলহো এর বই সমগ্র-তে স্থান পাওয়া উপন্যাসগুলোর মাঝে ‘দ্য আলকেমিস্ট’, ‘ব্রিদা’, ‘দ্য ডেভিল এন্ড মিস প্রাইম’, ‘দ্য জহির’, ‘দ্য ভ্যালকাইরিস’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ‘দ্য মাডি রোড’, ‘দ্য রং গিফট’, ‘দ্য জায়ান্ট ট্রি’, ‘দ্য ফিশ হু সেভড মাই লাইফ’, ‘আই উড র্যাদার বি ইন হেল’, ‘রিবিল্ডিং দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর মতো ছোটগল্পগুলোতেও দর্শনের প্রমাণ মেলে, যা পাঠকদের গভীরভাবে ভাবতে শেখায়। পাওলো কোয়েলহোর আরেক পরিচয় তিনি গীতিকার। বেশ কিছু জনপ্রিয় ব্রাজিলীয় গানের জনক তিনি।