আমার লেখক জীবনে আমি অণুগল্প দিয়ে নিজেকে প্রথম আত্মপ্রকাশ করি এবং আপনাদের সবার ভালোবাসায় সিক্ত হই অণুগল্প ‘বিচার’ লিখে। অনলাইনে গল্পের প্রতিযোগিতা রাখা হয়। আর মাত্র একটি রাত বাকি ছিল। রাত ফুরোলেই গল্প জমা দেওয়ার সময় শেষ। সেই রাতে সারারাত জেগে গল্পটি লিখেছিলাম। গল্পটি শেষ করে নিজেই কেঁদে ফেললাম। আমার কান্না দেখে আমার হাসবেন্ড গল্পটি পড়তে চাইল এবং কিছু জায়গায় এডিট করে দিল। তারপর ফজরের আজানের ঠিক আগ মুহূর্তে গল্পটি পাঠালাম। কোনো রকম আশা করিনি যে, সেরা গল্পকার হব। যখন আমাকে জানানো হয়, আমি গল্পটি লিখে সেরা গল্পকার হয়েছি তখন নিজেই অবাক হই। ২০১৭ তে এই গল্পটি লিখে চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য চর্চাকেন্দ্রে সেরা গল্পকার হই। তারপর থেকে আপনাদের ভালোবাসা পাওয়ার লোভে আর থেমে থাকিনি। বিভিন্ন পত্রিকায়, অনলাইন পত্রিকায় লিখে গিয়েছি। কয়েকটি বইও প্রকাশ করেছি কিন্তু অণুগল্পের বই প্রকাশ করা হয়নি। তাই আমার লেখা অণুগল্প নিয়ে এবারের বই প্রকাশ করেছি। আমার জীবনে বিভিন্ন সময়ের বাস্তব ও কাল্পনিক অণুভূতি ও প্রিয়জন, বন্ধু-বান্ধবদের জীবনী নিয়ে বেশকিছু অণুগল্প লিখেছি। তারমধ্যে ‘বিচার’ গল্পটি সবচেয়ে আলোচিত হয়। চুয়াডাঙ্গার সাহিত্য সমীকরণ পত্রিকায় আমার এই গল্পটি প্রকাশ করে এবং আমি ফেসবুকে গল্পটি পোস্ট করি। তখন এক জনপ্রিয় লেখক আমার এই গল্প নিয়ে অনেক সমালোচনা করেন, কেন গল্পটিতে রিকশাওয়ালাকে তুমি সম্বোধন করা হয়েছে? এছাড়া অনেকেই প্রশ্ন করেন, রিকশা ভাড়া এত কম কেন? এই সকল প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিতে হয়েছে। প্রথমত গল্পতে নদী ও শিউলি দু’জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এরা সাধারণত রিকশাওয়ালাকে তুমি সম্বোধন করে এবং সেই সাথে মামাও ডাকে। আমরা অনেকেই নিজের মামাকে তুমি সম্বোধন করি। এটা আমরা আপন ভেবেই করি। তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা রিকশাওয়ালাদের আপন ভেবেই তুমি সম্বোধন করে। তাদেরকে ছোট করার উদ্দেশ্যে তুমি সম্বোধন করে না। দ্বিতীয়ত রিকশাভাড়া বর্তমানের তুলনাই অনেক কম ছিল কারণ আমি গল্পের প্লট তৈরি করেছি ঐ সময়ের উপর ভিত্তি করে যখন ঢাকায় মিরপুর থেকে ধানমন্ডি রিকশা চলাচল করতে দিত। সময়টা ছিল অনেক আগের তাই রিকশাভাড়া তখনকার সময়ে যা ছিল তাই দেখিয়েছি। আমি আজ ২০২৩ সালে লিখছি বলে সত্তর দশক, আশির দশক কিংবা নব্বই দশকের চিত্র গল্পে তুলে ধরতে পারব না এমন কোনো সংবিধান নেই। আমাদের উচিত পূর্বের ঘটনা, ঐতিহ্য বেশি বেশি করে তুলে ধরা যাতে আমরা আমাদের অতীত ভুলে না যাই। এবার আমার লেখা আরেকটি অণুগল্প প্রসঙ্গে কিছু স্মৃতি আপনাদের সাথে শেয়ার করব। চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য চর্চা কেন্দ্রর দ্বিতীয় অনুষ্ঠান চুয়াডাঙ্গা শিল্পকলা একাডেমির মুক্ত মঞ্চে ‘এখনো অন্ধকার হয়নি’ গল্পটি পাঠ করেছিলাম। আমাকে বলা হয়েছিল, আমার নিজের লেখা গোধূলির উপর একটি গল্প অনুষ্ঠানে পাঠ করতে হবে। সেসময় কোরবানী ঈদের ঝামেলায় ঢাকায় বসে গল্প লেখার সময় করে উঠতে পারিনি। তাই চুয়াডাঙ্গা যাওয়ার পথে বাসে বসে মোবাইলেই গল্পটি লিখে ফেলি। যখন এই গল্পের একটি লাইন আমি পাঠ করি - গাল বরাবর সজোরে একটা চড় দিয়ে জোসনা বলল...তখন অনেকেই কেঁপে উঠেছিল। এই দৃশ্যটি বেশ দেখার মতো ছিল। এই গল্পটিকে ঘিরে অনুষ্ঠানে আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। ঐদিনের কথা মনে পড়লে ভালো লাগার মুহূর্তগুলো আজও আমি অনুভব করি। সেদিন গুরুজনদের মাঝে একজন একটি কথা বলেছিলেন, তা হচ্ছে, লেখক হতে হলে চামড়াটা গন্ডারের চামড়ার ন্যায় হতে হবে। উনার এই উপদেশ আমি সারাজীবন মাথায় নিয়ে রাখব এবং অন্যদেরও একই উপদেশ দেবো। আমার লেখা ‘তোমার মতো করে’ গল্পটি আমার মাকে কাঁদিয়েছিল। সেই সাথে আমার সন্তানকেও। আমি সেইবার আমার বাবা-মা, সন্তান ও সন্তানের বাবাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাই। আমার দাদার খাটে বসে এই গল্পটি পাঠ করি। আমার সামনে আমার মা ও সন্তান ছিল। দেখি আমার মা আঁচল দিয়ে তাঁর চোখ মুছছেন। আমার সন্তান আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল। আমার চাচি জানালার পাশে ঘরের বাইরে উঠোনে ছিলেন। ওখান থেকে উনি গল্পটি শুনছিলেন। গল্প শোনার পর উনি আমার কাছে ছুটে আসলেন। বললেন, ‘‘দীপ্তি, তুমি এটা কী গল্প লিখেছ? আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।’’ একদিন ভোরে আমি হাঁটতে বের হয়েছিলাম। হেঁটে ফেরার পথে এক এতিমখানা থেকে কান্নার আওয়াজ পেয়েছিলাম। বাচ্চাটি মা, মা করে কাঁদছিল। ঐ এতিমখানায় বাবা-মা কেউ নেই এমন এতিমদের রাখা হয়। সেদিন বাসা ...মুনমুন ফেরদৌসী দীপ্তি