এই গ্রন্থে আমি যে-কথাটি বলতে চেয়েছি, তা হলো : বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তি-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুর যে-সংগ্রাম, তা নতুন প্রজন্মকে উপলব্ধি করতে হবে; বুঝতে হবে কেন তিনি জীবনের সব আরাম-আয়েশ,পার্থিব সুখ বিসর্জন দিয়ে যৌবনের অর্ধেক সময় কারান্তরালেই কাটিয়েছিলেন। তাঁর জীবনের ধ্রুব লক্ষ্যই ছিল প্রতিটি বাঙালির, বিশেষত কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুর, যারা সম্পদ সৃষ্টি করে; কিন্তু সে সম্পদের অতি সামান্যের ভাগ পায়, দুঃখী জীবনযাপন করে, তাদের দুঃখের অবসান ঘটানো, দারিদ্র্যের বন্ধন থেকে মুক্ত করা। স্বাধীনতা-উত্তরকালে অসংখ্য ভাষণে এই কথা তিনি কেবল বারবার ব্যক্তই করেননি; তাকে বাস্তবতায় মূর্ত করারও চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু তাঁর এই মহৎ প্রচেষ্টার পূর্ণতা পাওয়ার যে অপার সম্ভাবনা তিনি নানাভাবে সৃষ্টি করেছিলেন, তা পাকিস্তানপন্থি দুর্বৃত্তরা থামিয়ে দেয় এক অতি নির্মম-নিষ্ঠুর পন্থায়-তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। এত নিষ্ঠুর, এত অমানবিক এমন হত্যাকাণ্ড বিশ্ব-ইতিহাসে নেই বললেই চলে। বিশ্ব-ইতিহাসে এত মানুষের হত্যাকাণ্ডকে আইনগতভাবে বিচারবহির্ভুত বিষয়-হিসেবে ঘোষণা করার দৃষ্টান্তও অতি বিরল। তাঁর এই হত্যাকাণ্ডের ফলে বাঙালি জাতির জীবনে যে-অমোচনীয় কলঙ্কের রেখা পড়ল, তা থেকে বাঙালি মুক্ত হতে পারে-যদি তাঁর আদর্শকে ধারণ করে নতুন প্রজন্ম বাঙালিকে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বর্ণাবর্ত্মে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়, একটি যথার্থ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে, যেখানে প্রত্যেকটি মানুষ মানুষের মর্যাদা পায়। তা হলেই বঙ্গবন্ধু-সম্পর্কে আমার এই সামান্য রেখাচিত্র সার্থক হবে। অনুপম সেন
অনুপম সেন একজন জ্ঞানতাপস, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিরল ব্যক্তিত্ব। একাধারে তিনি সমাজবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, অনুবাদক, শিক্ষাবিদ ও বরেণ্য বুদ্ধিজীবী। অনুপম সেনের জন্ম ১৯৪০ সালের ৫ই আগস্ট চট্টগ্রাম শহরে। তাঁর মাতা স্নেহলতা সেন ও পিতা বীরেন্দ্রলাল সেন। বীরেন্দ্রলাল সেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে এমএ এবং রিপন কলেজ থেকে বিএল ডিগ্রি অর্জন করে ১৯২০ সালে চট্টগ্রাম কোর্টে ওকালতি শুরু করেন। তাঁর প্রমাতামহ ছিলেন বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত ও তিব্বত-পরিব্রাজক শরচ্চন্দ্র দাশ। শরচ্চন্দ্র কর্তৃক তিব্বত থেকে উদ্ধারকৃত ও অনূদিত মহাকবি ক্ষেমেন্দ্রের 'বোধিসত্ত্ব অবদান কল্পলতা'-এর গল্প অবলম্বন করেই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন 'শ্যামা', 'পূজারিনী' প্রভৃতি অসাধারণ নৃত্যনাট্য ও কবিতা। তাঁর জ্যেষ্ঠতাত ছিলেন বাংলা সমালোচুল সাহিত্যের জনক কবিভাস্কর শশাঙ্কমোহন সেন। স্বাভাবিক যে, অনুপম সেন শৈশব থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠার সুযোগ পান। অনুপম সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্ব বিষয়ে বিএ (অনার্স) এমএ এবং কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ চার দশক ধরে শিক্ষকতা পেশায় ব্রতী ছিলেন। বর্তমানে তিনি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। সমাজতত্ত্বের ছাত্র হলেও তাঁর পড়াশোনা ও গবেষণার ক্ষেত্র বহুমাত্রিক। মানবসভ্যতার ইতিহাস, বাঙালি রেনেসাঁস, বাংলাভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও দেশচেতনা ইত্যাদি তাঁর জীবনকেন্দ্রিক অধ্যয়নের মূলগত বিষয়। তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও কর্মসাধনা তাঁকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। শিক্ষা ও সমাজভাবনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০১৪ সালে 'একুশে পদক'সহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদান রাখেন। বলা যায়, স্বাধীনতা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সকল অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজপথের সাহসী মানুষ তিনি। বিশ্ববিখ্যাত প্রকাশক Routledge তাঁর The State, Industrialization and Class Formations in India গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। এছাড়াও তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ- 'বাংলাদেশ: ভাবাদর্শগত ভিত্তি ও মুক্তির স্বপ্ন'; 'কবি-সমালোচক শশাঙ্কমোহন সেন'; 'সাতটি বক্তৃতা: বাঙালি-মনন, বাঙালি সংস্কৃতি'; 'সুন্দরের বিচার সভাতে'; 'বিলসিত শব্দগুচ্ছ'; 'জীবনের পথে-প্রান্তরে'; 'বাংলাদেশ: রাষ্ট্র ও সমাজ, সামাজিক অর্থনীতির স্বরূপ'; 'বাংলাদেশ ও বাঙালি রেনেসাঁস, স্বাধীনতা-চিন্তা ও আত্মানুসন্ধান'; 'ব্যক্তি ও রাষ্ট্র: সমাজ-বিন্যাস ও সমাজ-দর্শনের আলোকে; 'আদি-অন্ত বাঙালি বাঙালি সত্তার ভূত-ভবিষ্যৎ'; ইতিহাসে অবিনশ্বর: 'অসাম্যের বিশ্বে সাম্যের স্বপ্ন' পাঠকসমাজে ব্যাপকভাবে আদৃত হয়েছে