একনজরে ৩০ খন্ডে ঐতিহ্য রবীন্দ্র-রচনাবলি ১. বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রকাশনা-২২৫০০ পৃষ্ঠারও অধিক ২. রবীন্দ্রনাথের প্রাপ্ত সমগ্র বাংলা রচনা, প্রকাশক্রম- অনুসারে ত্রিশ খন্ডে নতুনভাবে বিন্যাস করা হয়েছে। ৩. এই প্রথম ‘ছিন্নপত্র’ (শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লিখিত আটটি পত্র) অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। ৪. ‘ছিন্নপত্র’সমূহের পূর্ণতর পাঠ ‘ছিন্নপত্রাবলী’ (ইন্দিরা দেবীকে লিখিত পত্রাবলীর পূর্ণতর সংস্করণ) অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। ৫. ‘চিঠিপত্র’(১-১৯ খন্ড)রচনাবলিতে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। ৬. প্রমথনাথ বিশীকে লিখিত পত্র অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। ৭. ভানুসিংহের পত্রাবলী অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। ৮. পথে ও পথের প্রান্তে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। ৯. অখন্ড ‘গীতবিতান’ ভিন্ন রূপে ও প্রকরণে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। ১০. সাহিত্য-ছবি-গান ও সুরের মিথস্ক্রিয়ার দিকে লক্ষ রেখে রবীন্দ্রনাথ- অঙ্কিত ‘ রূপ-বিরূপে’র দুই শতাধিকেরও বেশী রঙিন ছবি রচনাবলিতে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। ১১. ঐতিহ্য রবীন্দ্র-রচনাবলিতে ব্যবহার করা হয়েছে ভার্জিন রেজিনে তৈরি বিশ্ব মানের ন্যাচারাল কালার অফসেট কাগজ। ১২. ঝকঝকে ছাপা ও মজবুত বাঁধাই রচনাবলিকে দিয়েছে স্বাতন্ত্র।
ভূমিকার অংশ ঐতিহ্যের উদ্যোগে ত্রিশ খণ্ড রবীন্দ্র-রচনাবলি প্রকাশিত হল। প্রসঙ্গক্রমে বলা বাঞ্ছনীয় যে, বিশ্বভারতী সংস্করণে রচনা বিন্যাসের সময় কৈশোর ও যৌবনের রচনাসমূহের বিপুলাংশ, রবীন্দ্রনাথের ‘বর্জন অভিপ্রায়’ ও ‘বিরাগ’ মান্য করে বিশ্বভারতী গ্রন্থপ্রকাশ-সমিতির অধ্যক্ষেরা ‘অচলিত সংগ্রহ’ প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড নামে প্রচলন করেন, যা প্রকাশাবধি প্রচলিত আছে। এমনকী বিশ্বভারতীর প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় সংকলিত রচনাগুচ্ছকে রবীন্দ্রনাথ অপরিপুষ্ট, অবাঞ্ছিত নির্দেশ করে প্রচলনে দ্বিধা, অনাগ্রহ জানিয়েও পাশাপাশি তিনি লেখেন : ‘আজ যদি আমার সমস্ত রচনার সমগ্র পরিচয় দেবার সময় উপস্থিত হয়ে থাকে তবে তাদের মধ্যে ভালো মন্দ মাঝারি আপন আপন স্থান পাবে এ কথা মানা যেতে পারে। তারা সবাই মিলে সমষ্টির স্বাভাবিকতা রক্ষা করে।... মানুষ সামনের দিকে যেমন অগ্রসরণ করে তেমনি অনুসরণ করে পিছনের, নইলে তার চলাই হয় না। পিছনহারা সাহিত্য বলে যদি কিছু থাকে সে কবন্ধ, সে অস্বাভাবিক।’ এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টির ক্রমবিকাশে কালপরিসর, অবচেতনা, মনঃসমীক্ষণউৎস ও ঐতিহাসিক-তাৎপর্যকে বারংবার গুরুত্ব দিয়েছেন। স্মরণীয়, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে “স্বদেশ” নামক একটি কবিতা পাঠানোর সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠিতে জানান : ‘অকিঞ্চিৎকর বলে আমার কোনো বইয়ে স্থান পায় নি। কিন্তু... ঐতিহাসিকের দফতরে এর স্থান থাকতে পারে।’Ñ ৩১ আশ্বিন ১৩২৮ [দেশ, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৩৮২] বিশ্বভারতী রবীন্দ্র-রচনাবলীর ‘নিবেদন’-এ চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন : ‘রবীন্দ্রনাথের সমগ্র বাংলা রচনার একটি নূতন সংস্করণ খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশের আয়োজন হইল।... এইখানে একটি কথার উল্লেখ প্রয়োজন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত কবির অনেক রচনা কোনো পুস্তকে সন্নিবিষ্ট হয় নাই। সেই-সকল রচনা সংগৃহীত হইতেছে, সর্বশেষ খণ্ডে সেগুলি সন্নিবিষ্ট হইবে। প্রকাশকাল অনুসারে সেগুলি যথাস্থানে যোজনা করা এখন আর সম্ভব হইল না।’ বিশ্বভারতী সংস্করণ ক্রমশ খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হওয়ায় রবীন্দ্রনাথের রচনাকাল বা প্রকাশকালের পরম্পরা অনিবার্যভাবেই রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ফলে রবীন্দ্রপ্রতিভার বিষয়বৈভব, রূপবৈচিত্র্য, দর্শন এবং দৃষ্টি-সৃষ্টির ক্রমবিকাশ বা রূপান্তর নির্ণয় অসম্পূর্ণ থেকে যায়; কখনো কখনো তা আকস্মিক বলেও প্রতীয়মান হয়। এ সত্য বহু বিদিত যে, সমাজ-সভ্যতার আত্মরূপ ও ‘সবদেশী’ রবীন্দ্রনাথের সৃজনশক্তির অবচেতন-স্মৃতিজড়িত ও অন্তর্গূঢ় প্রতিভান-বীজ উৎসারিত হয়েই তাঁর সৃষ্টি শাখাপত্রপুষ্প-সমাচ্ছন্ন হয়ে-ওঠা মহীরূহ। উল্লিখিত বক্তব্য ও পরিপ্রেক্ষিত স্মরণে রেখেই রবীন্দ্রনাথের প্রাপ্ত সমগ্র বাংলা রচনা, প্রকাশক্রম-অনুসারে ত্রিশ খণ্ডে নতুনভাবে বিন্যাস করা গেল। বিশ্বভারতী রবীন্দ্র-রচনাবলী অচলিত সংগ্রহ দু-খণ্ডই, প্রকাশ কাল অনুসারে, বর্তমান রচনাবলিতে যথাস্থানে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। ঐতিহ্য-প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলিতে এই প্রথম ‘ছিন্নপত্র’ (শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লিখিত আটটি পত্র), ‘ছিন্নপত্র’সমূহের পূর্ণতর পাঠ ‘ছিন্নপত্রাবলী’ (ইন্দিরা দেবীকে লিখিত পত্রাবলীর পূর্ণতর সংস্করণ), ‘চিঠিপত্র’ (১-১৯ খণ্ড), ‘প্রমথনাথ বিশীকে লিখিত পত্র’, ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ ও ‘পথে ও পথের প্রান্তে’ অন্তর্ভুক্ত হল। অখণ্ড ‘গীতবিতান’ও ভিন্ন রূপে ও প্রকরণে সন্নিবিষ্ট করা গেল।
৩ ‘তত্ত্বের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচিন্তা ও শিল্পচিন্তা এক খাতেই রয়েছে। রবীন্দ্র-নন্দনতত্ত্বে এদের অবিরোধী সহভাব।’ রবীন্দ্রনাথ জাপানযাত্রী : ১৪ তে লিখেছেন : ‘রূপরাজ্যের কলা ছবি, অরূপরাজ্যের কলা গান। কবিতা উভচর, ছবির মধ্যেও চলে, গানের মধ্যেও ওড়ে।’ সাহিত্য-ছবি-গান ও সুরের মিথস্ক্রিয়ার দিকে লক্ষ রেখেই রবীন্দ্রনাথ-অঙ্কিত ‘রূপ-বিরূপে’র দুই শতাধিকেরও বেশি রঙিন ছবি রচনাবলির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মুদ্রিত কোনো ছবিরই শিরোনাম নির্দেশ করা হল না। কেননা : Rabindranath wanted viewers to look at his paintings without any directive intervention from his end. He perceived them as a visual statements that came to him somewhat unbidden and he did not wish to sully or curtail them with titles. [A Guide to the Catalogue, RABINDRACHITRAVALI, Pratikshan, Kolkata 2011, page 6-7] এতদব্যতীত সংযুক্ত হয়েছে বিশ্বভারতী রচনাবলী-বহির্ভূত রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু ফোটোগ্রাফ, দেশি-বিদেশি শিল্পী-অঙ্কিত প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।