ভূমিকা ‘পরানে পড়িয়াছে টান’ উপন্যাস হয়ে ওঠার পেছনে ছোট একটা গল্প আছে। শুরুতে সেটা বলে নেওয়া দরকার। পেশাগত কারণে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাকে কিছু কাজ করতে হয়েছে। তা করতে গিয়ে মনে হলো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে প্রচুর কাজ হলেও এখনো অনেক কাজ বাকি। সবচেয়ে বড় কথা, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে এখনও জীবিত। আরো এক কিংবা দুই দশক পরে চাইলেও হয়তো জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা পাব না। তাদের সবার তো যুদ্ধস্মৃতি বা যুদ্ধদিনের গল্প আলাদা; বলার ভঙ্গি আলাদা, দেখার চোখও আলাদা। সেগুলো তো আমাদের জেনে রাখা দরকার, সংরক্ষণ করা দরকার। যাতে পরবর্তী প্রজন্মের কেউ এসব নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী হলে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি না হয়। এমন ভাবনা থেকে আমি পেশাগত কাজের বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণের কাজ শুরু করি। পেশাগত ব্যস্ততার মাঝে সপ্তাহে একদিন যেটুকু সময় হাতে পাই, ছুটে যাই কোনো না কোনো মুক্তিযোদ্ধার কাছে। অনেকে আগ্রহ নিয়েই কথার ঝাঁপি খুলে বসেন। অনেকে সহজে বলতে রাজি হন না। বলেন, এসব বলে লাভ কী? তাদের নানা আক্ষেপ, নানা ক্ষোভ, নানা অভিমান। যাই হোক, আমি দমে থাকি না। প্রায় প্রতি শুক্রবারে নিয়ম করে সকালে বেরিয়ে পড়ার চেষ্টা করি মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারে দ্বারে। তারা শোনান গৌরবময় দিনের কথা। সেগুলো আমি সাক্ষাৎকার আকারে সংরক্ষণ করতে থাকি। এরকমই এক মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিতে নিতে আমিও যেন হারিয়ে যাই সেই দিনগুলোতে। এত দীর্ঘ সাক্ষাৎকার তো আর ছাপানো সম্ভব নয়। পাঠকেরও ধৈর্য ধারণের একটা মাত্রা আছে। মনে মনে ঠিক করি মূল আঙ্গিক ঠিক রেখে এ নিয়ে একটা গল্প লিখব। এরকম পরিকল্পনা আমি নানা সময় করি। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখে না। কিন্তু এখানে ব্যতিক্রম ঘটে। এই স্মৃতিগল্পটি আমার মাথা থেকে যায় না। আমি মাথায় নিয়ে ঘুরতে থাকি। একদিন আড্ডায় বিষয়টি বলি গল্পকার-প্রাবন্ধিক ফায়যুর রাহমান ও লেখক হওয়ার অপার সম্ভাবনাকে গলা টিপে প্রবাসে থিতু হওয়া সালমান আহমদকে। সে ২০১২ সালের কথা। এরপর বিপদে পড়ি। তাদের সঙ্গে দেখা হলেই চাপ দেন, ‘লিখে ফেলেন’। পরে আর লেখা হবে না। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তারা বলেই চলেন। একটা পর্যায়ে তাদের নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গল্পটা দাঁড় করানোর চেষ্টা করি। লেখা শেষ হলে তারা দুইজনের হাতে তুলে দিই। তারা বিপুল আগ্রহ নিয়ে পুরো রাত জেগে গল্প নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেন। পরে আমাকে বলেন, এটাকে উপন্যাসের আঙ্গিক দেওয়া গেলে ভালো একটি উপন্যাস হয়ে যাবে। আমার কাছেও মনে হয় তাদের পরামর্শ মন্দ না। কিন্তু সাহস করতে পারি না। কারণ মাঠের সাংবাদিকতা যারা করেন, তারা জানেন উপন্যাস লেখার যে-প্রস্তুতি দরকার, সেই সময় এ পেশায় থেকে বের করা কঠিন। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। মূলত তাদের উৎসাহে, আন্তরিকতায় এবং লেগে থাকায় আমার পক্ষে রীতিমতো অসম্ভব একটা কাজ সম্ভব হয়ে উঠেছে। এখানে আমার যতটুকু কৃতিত্ব কিংবা শ্রম, আমার মনে হয় তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় তাদের পরিশ্রম। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। ইয়াহইয়া ফজল রায়নগর, সিলেট