১৯৪৭ সালের কথা মনে আছে? সেই যে দেশভাগ হলো। দেশ বিভাগের নামে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হলো। মনে আছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ তার শতজনমের ভিটা ত্যাগ করে নিঃস্ব হয়ে দেশান্তরি হয়েছিল-মনে আছে? আচ্ছা, বলুন তো-এই দেশভাগের জন্য সেদিনের সেই মাটিবর্তী পূর্বপুরুষ কি প্রস্তুত ছিলেন? ১৯৬৪ সালে এই পূর্ববঙ্গে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলো-এর জন্য কি প্রস্তুত ছিলেন? না, ছিলেন না। দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ হিন্দুসম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষকে ছুরি দিয়ে, দা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হাজার-হাজার ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ লক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও সম্পত্তি ফেলে, নিঃস্ব হয়ে, শতজনমের জন্মভিটা ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে ভারত চলে গিয়েছিলেন। আবার ভারত থেকেও শতপুরুষের ভিটেমাটি রেখে, বঞ্চনা-নির্যাতনে দগ্ধ হয়ে শুধু সাম্প্রদায়িকতার অজুহাতে অসংখ্য মুসলমানও বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাজনৈতিক খেলার এই দেশান্তরি কি মেনে নেয়া যায়? আমার মামার পরিবারও ছিল সেই দেশান্তরি লক্ষ পরিবারের একজন। মামার এ-হেন দেশত্যাগ ও ভারতে গিয়ে আর্থিক কষ্টে মামার অভাব-অনটনে থাকা-এইসব সংবাদ মা জানতেন। কিন্তু মা’র এমন মনোকষ্ট আমাদের সাথে কখনো ভাগাভাগি করেননি। অথচ মা ছিলেন এমন এক পরিবারের গৃহবধূ, যে পরিবার চার পাঁচ পুরুষ পর্যন্ত ধনী ও সচ্ছল। মার বাবাও যে পরিমান সম্পদ ও সম্পত্তির মালিক ছিলেন-যা মামা পরিত্যক্ত রেখে রাতের আঁধারে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেই সম্পত্তি পরবর্তীতে তদানীন্তন সরকার শত্রু সম্পত্তি বলে আখ্যায়িত করলেন। ‘শত্র’ সে-তো এক ঘৃণার উচ্চারণ। মা-মাসি-মামা যে ভাবে বড় হয়েছেন সেখানে তো শত্রু ছিলো না। সেন্টু রায় সুদূরের পিয়াসী গ্রন্থে প্রিয়জন হারানোর বিষাদ ও যন্ত্রণার কথাই লিখেছেন। সময়ের অভিজ্ঞানে গ্রন্থটি মূলত সময়-সমাজ-সামাজিকতার ইতিহাস।