বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। সে দেশটির নাম বাংলাদেশ। প্রতিটি স্বাধীন দেশের মতো আমাদেরও রয়েছে একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড। রয়েছে জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত। রয়েছে জাতীয় ফুল, জাতীয় ফল, জাতীয় ভাষা, জাতীয় মাছ আরো কত কি! এ যে কতো আনন্দের, কতো গর্বের সে শুধু আমরাই জানি। যে স্বাধীনতা নিয়ে আমাদের এতো গর্ব, এতো আনন্দ- সে স্বাধীনতাকে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম পাকিস্তানিদের কাছ থেকে। আর এ জন্যে আমাদেরকে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিলো এক মরণপণ যুদ্ধে। সে যুদ্ধ ছিলো মুক্তিযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে প্রাণ দিতে হয়েছিলো ত্রিশ লাখ বাঙালিকে। স্বাধীনতা আদায়ের প্রশ্নে জাতি হয়েছিলো দুর্জয় সাহসী হয়েছিলো ঐক্যবদ্ধ। জাতির এই একতা আর দেশপ্রেমের পেছনে যার আবদান ছিলো সবচেয়ে বেশী, তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই নিরলস প্রচেষ্টা আর নির্ভীকতায় অনুপ্রাণিত হয়ে জেগে উঠেছিলো একটি নির্যাতিত পরাধীন জাতি। খালি হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে পরাজিত করেছিলো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এক সামরিক বাহিনীকে। এ সবই সম্ভব হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের সঠিক নির্দেশনায়। তাই শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেছেন এক প্রাতঃস্মরণীয় নাম এ দেশের ঘরে ঘরে। যতোদিন এদেশে একটি মানুষও বেঁচে থাকবে- অন্তত ততদিন তাঁর বুকে বেঁচে থাকবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা তারিখ অনুযায়ী সে দিনটি ছিলো ১৩২৭ সালের ২০ চৈত্র, মঙ্গলবার। রাত আটটার সময় জন্ম হয়েছিলো তাঁর। শেখ মুজিবুর রহমানের পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান। মাদারিপুর দেওয়ানি আদালতে সেরেস্তাদারের চাকরি করতেন তিনি। সৎ, দয়ালু, আর প্রতিবেশীদের মঙ্গলকামী বলে পরিচয় ছিলো তার। ওদিকে মুজিবুর রহমানের মাতা সায়রা খাতুনও ছিলেন যেমন ধার্মিক ঠিক তেমনি ¯েœহপরায়ণ। গাঁয়ের গরিব দুঃখি মহিলাদের সাধ্যমতো দান করতেন তিনি। এতিম অসহায়দের আশ্রয় দিতেন নিজের বাড়ীতে। পিতা-মাতার এই ভালো গুনগুলোরই অধিকারী হয়েছিলেন শেখ মুজিব। আর তাই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব, যুবক-বৃদ্ধ সবাইকে স্বাধীনতার দাবিতে একতাবদ্ধ করা। বংশ পরিচয় যতোটুকু জানা যায়, শেখ মুজিবুরের পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস ছিলো ইরাকে। বিখ্যাত আউলিয়া হযরত বায়েজিদ বোস্তামীর (র) সাথে ইসলাম প্রচারের জন্য যেসব ভক্ত খাদেমরা এদেশে এসেছিলেন, তাঁদের ভেতর একজনার নাম ছিলো দরবেশ শেখ আউয়াল। কিছুদিন চট্টগ্রামে থাকার পর তিনি চলে আসেন সোনারগাঁ। এখানেই বিয়ে করেন তিনি। এক বছর পর তার একটি ছেলে হয়। এ ছেলের নাম ছিলো শেখ জহির উদ্দিন। শেখ জহির উদ্দিন বড় হয়ে চলে আসেন গোয়ালন্দ। এখানে কুরসি গ্রামের পাশের গ্রামে বিয়ে করেন তিনি। তার ছেলের নাম রাখা হয় শেখ জান মাহমুদ। তেকড়ি শেখ নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। শেখ জান মাহমুদের ছেলে শেখ বোরহানউদ্দিন জীবিকা হিসেবে বেছে নেন ব্যবসা। ব্যবসার প্রয়োজনে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হতো তাকে। ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে একবার তিনি আসেন টুঙ্গিপাড়ায়। শেখ বোরহান উদ্দিন ছিলেন তিন ছেলের জনক। তাঁর দ্বিতীয় ছেলের নাম ছিলো শেখ আবদুল হামিদ। ইনিই ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের দাদা- শেখ লুৎফর রহমানের পিতা। পিতা-মাতার ছয় সন্তানের ভেতর মুজিবের স্থান ছিলো তৃতীয়। আর পুত্রদের ভেতর বড়ো ছিলেন তিনি। এখানেই থেকে যান শেখ বোরহানউদ্দীন। টুঙ্গিপাড়ার কাজি বাড়ির এক মেয়েকে বিয়ে করেন তিনি। শিক্ষা জীবন ছেলেবেলা থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের অধিকারী। আর ছিলো তাঁর চমৎকার সাংগঠনিক শক্তি। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে দল উৎসাহের অন্ত ছিলো না তার। ছোটরা তাঁকে ডাকতো খোকা ভাই বলে। কারণ ওটাই ছিলো তার ডাক নাম। ছেলেবেলায় গৃহশিক্ষকের কাছেই হাতেখড়ি হয় শেখ মুজিবের। তাঁর প্রথম শিক্ষকের নাম ছিলো পন্ডিত শাখাওয়াত উল্লাহ। যেমন মিষ্টভাষী ঠিক তেমনি গুনী শিক্ষক ছিলেন তিনি। ছাত্রদের সাথে বন্ধুর মতো মিশে কঠিন পড়াগুলোকে সহজ করে-দিতে খুবই পটু ছিলেন তিনি। গৃহশিক্ষকের পড়া শেষ হলে ১৯২৭ সালে মুজিবকে ভর্তি করা হয় গিমাডাঙ্গা-টুঙ্গিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখানে অবশ্য খুব বেশিদিন পড়ার সুযোগ পাননি তিনি। কারন এগারো বছর পা দেয়ার পরপরই ১৯৩১ সালে তাঁর পিতা তাঁকে নিয়ে যান মাদারিপুরে। সেখানেই সেরেস্তাদারের চাকরি করতেন তিনি। মাদারিপুরে শহরে ছিলো ইসলামিয়া হাইস্কুল নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয়। এই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেয়া হয় শেখ মুজিবকে। এখানে তিনি আক্রান্ত হোন বেরিবেরি রোগে। এ রোগের কারণে চোখও নষ্ট হয়ে যায় তাঁর। পরে অবশ্য কোলকাতা নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু মাদারীপুরেও বেশিদিন থাকা হয়ে ওঠে না শেখ মুজিবের। কারণ এরই মাঝে তাঁর পিতাকে বদলি করা হয়েছিলো গোপালগঞ্জ। মাদারিপুরের পাট চুকিয়ে তাই মুজিবকে নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন গোপালগঞ্জে। সে সময় গোপালগঞ্জ শহরে ভালো স্কুল ছিলো না বললেই চলে। একটি স্কুল ছিল মাঝারি মানের। সেই গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুল। সেই হাইস্কুলেই ভর্তি করে দেয়া হয় শেখ মুজিবকে। এবার তিনি ভর্তি হন পঞ্চম শ্রেণিতে। মিশন হাইস্কুলের হেডমাস্টার মশাইয়ের নাম ছিলো গিরিশ চন্দ্র। মানুষ হিসেবে খুবই আমুদে ছিলেন তিনি। মাঝে মধ্যেই নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো স্কুলে। তিনি নাটক লিখতেন সে সব অনুষ্ঠানের জন্যে ছাত্ররা অভিনয় করতো। গান লিখতেন- ছাত্ররা দলবেঁধে গান গাইতো। অন্য স্কুলের ছেলেদের সাথে আয়োজন করা হতো ফুটবল নয়তো হাডুডু খেলার। শেখ মুজিব অংশগ্রহন করতেন সেসব খেলায়। অন্যদের চেয়ে ভালোই খেলতেন তিনি। আর এজন্যে স্কুলের বন্ধুরা দলপতি হিসেবে মেনেও নিয়েছিলো তাঁকে। সকালের সূর্যের দিকে তাকালেই যেমন দিনটি সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়, বালক মুজিবকে দেখেও তেমনি সবাই বুঝতে পেরেছিলো ভবিষ্যতে তিনি দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করবেন। কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস ছেলেবেলা থেকেই তাঁর ভেতর স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো। যাকে সত্য বলে জানতেন, যাকে ন্যায় বলে বিশ্বাস করতেন, তার পক্ষে দাঁড়াতে কখনো ভয় পেতেন না তিনি। এ গুণটি বজায় ছিলো তাঁর মৃত্যুর মুহুর্তটি পর্যন্ত। শেখ মুজিব যখন ছোট ছিলেন তখন এই দেশে ছিলো ইংরেজদের শাসনাধীন। দুর্দান্ত দাপটের সাথে এ দেশ শাসন করতো ইংরেজরা। এ দেশের মানুষকে তারা মনে করতো জন্তুজানোয়ারের চেয়েও অধম। কথায় কথায় গুলি করে মারতো, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতো, ঘরবাড়ী কেড়ে নিয়ে ভিক্ষুক বানিয়ে ছাড়তো। এমনকি নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে এ দেশের তাঁতিদের আঙুলও কেটে দিয়েছিলো তারা! এতো অত্যাচার করতো যে, লিখে শেষ করা যাবে না। তাই ইংরেজদের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল এ দেশবাসী। সেই ইচ্ছে জন্ম নিয়েছিলো মুজিবের ভেতরও। স্কুল জীবনেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দেশবাসীকে স্বাধীন করতে না পারলে এ জাতির উন্নতি হবে না। শিক্ষার প্রসার হবে না। মানুষের জীবন যাত্রার মান বাড়বে না। আর তার চেয়েও বড় কথা, অন্যান্য জাতির সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানো যাবে না। এ লজ্জা কোনো আত্মসম্মান সচেতন মানুষ মেনে নিতে পারে না। স্কুলের বন্ধুদের কাছে এসব কথা প্রায় খুলে বলতেন মুজিব। বলতেন, আজ আমরা পরাধীন। কিন্তু সব সময় তো আমরা পরাধীন ছিলাম না। আমাদের সোনালি ফসল আর সম্পদের লোভে পড়ে বারবার ভিনদেশী পররাজ্য লোভীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদের নিরীহ মানুষগুলোর ওপর। ছলে বলে কৌশলে তারা দখল করে নিয়েছে আমাদের ছায়াঘেরা পাখিডাকা নদীমাতৃক এই বাংলাদেশ। একটি জাতির জন্যে এরচে দুঃখের আর কি হতে পারে। দুঃখকে মাথা পেতে নেয় তারাই, যাদের মাঝে রুখে দাঁড়াবার মতো শক্তি নেই- দুঃখকে জয় করার মতো সাহস নেই। কিন্তু আমরা তো তেমন জাতি নই! আমরা বাঙালি। আমরা স্বাধীনতা প্রিয় জাতি। ভিন দেশীদের কাছ থেকে বারবার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছি আমরা। তাই যেভাবেই হোক, এবারও পরাধীনতার শিকল ছিড়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবোই আমরা। ১৯৩৯ সালে শেখ মুজিব যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, সেসময় সারাটা উপমহাদেশ জুড়ে চলছিলো ইংরেজ তাড়াবার আন্দোলন। এসব আন্দোলন যারা পরিচালনা করছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর শেরে বাংলা ফজলুল হক। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪০ সালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক আর খাদ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী এসে হাজির হন গোপালগঞ্জে। এ কথা জানতে পেরে মুজিব ছুটে যান তাদের কাছে। তাঁদের প্রশ্ন করে করে জেনে নেন ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের সর্বশেষ অবস্থা- জেনে নেন ছোটরা কি করে এই আন্দোলনে শরিক হতে পারে সে কথা। মুজিবের প্রশ্নের গভীরতা দেখে বিস্মিত হন সোহরাওয়ার্দী। মনোযোগ দিয়ে তিনি শোনেন মুজিবের প্রতিটি প্রশ্ন। তারপর রাজনীতির বর্তমান অবস্থা, মারপ্যাচ বুঝিয়ে দেন খুব সহজ ভাবে। বলেন, কখনো কোলকাতা গেলে মুজিব যেনো তার সাথে দেখা করে। প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই সোহরাওয়ার্দীর সাথে চমৎকার একটা অন্তরঙ্গ সর্ম্পক গড়ে ওঠে মুজিবের। সোহরাওয়ার্দী কোলকাতা ফিরে যাবার পর মুজিব চিঠি লেখেন তাকে। শত ব্যস্ততার মাঝেও সোহরাওয়ার্দী সেই চিঠির জবাব দেন তাঁর ছোট্ট ভক্তকে। চিঠিতে থাকে নানা খবর-হাজারো পরামর্শ। এভাবে ধীরে ধীরে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ও সাহসী নেতা হতে শেখ মুজিবকে সাহায্য করেন সোহরাওয়ার্দী। শেখ মুজিবুর রহমান যখন গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলের ছাত্র তখনই তিনি বিয়ে করেন তাঁর চাচাতো বোন ফজিলাতুন্নেসাকে। ফজিলাতুন্নেসার ডাক নাম ছিলো রানু। মুজিবের বাবা-মাও ছিলেন চাচাতো ভাই চাচাতো বোন। ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা (ম্যাট্রিক সমমান) পরীক্ষায় পাস করেন শেখ মুজিব। তারপর চলে যান কোলকাতা। সেখানে গিয়ে কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন তিনি। ছেলেবেলা থেকেই অপরের দুঃখে দুঃখিত হবার, অপরের অভাব মোচন করার মানসিকতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল মুজিবের মাঝে। একেবারে ছোট সময় টুঙ্গিপাড়ায় তিনি তাই করেছেন। গোপালগঞ্জে স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। তাদের নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন গরীব-দুঃখিদের পাশে। কোলকাতায় অগণিত মানুষ। মানুষের দুঃখ-দুর্দশার সংখ্যাও বেশি। তাই এখানে সমস্যা জর্জরিত মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার সুযোগও ছিলো বেশি। কোলকাতায় পা দিয়ে তিনি লুফে নেন সেই সুযোগ। নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন বিভিন্ন সেবামূলক সংগঠনের সাথে। তারই আন্তরিক চেষ্টায় গড়ে ওঠে ‘মুসলিম সেবক’ সমিতি। এ সমিতির সদস্যরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে চাল-ডাল সংগ্রহ করতো পুরনো কাপড় আর বইপত্র। এসব বন্টন করা হতো গরিব ছাত্রদের মাঝে। সে সময় কোলকাতায় মুসলমান ছাত্রদের থাকার জন্যে মাত্র দুটো ছাত্রাবাস ছিলো। একটি ছিলো ধর্মতলা স্ট্রীটে নাম বেকার হোস্টেল। অন্যটি কারমাইকেল হোস্টেল। শেখ মুজিব থাকতেন বেকার হোস্টেলে। তখন মুসলমান সমাজে সবেমাত্র পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়েছে। শিক্ষা-দীক্ষা আর জাতি সচেতনতা বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এই পরির্বতনের হাওয়া ছড়িয়ে পড়েছিলো মুসলমান ছাত্রদের মাঝেও। দ্রæত বৃদ্ধি পাচ্ছিলো তারেদর রাজনৈতিক সচেতনতা। তাই মুসলিম ছাত্রাবাস দু’টোতে বিরামহীনভাবে চলতো রাজনৈতিক আলোচনা। রাজনৈতিক কর্মকান্ড লেগেই থাকতো সেখানে। শেখ মুজিব তো এমন পরিবেশই কামনা করেছিলেন মনে মনে। সুতরাং কোলকাতা এসে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে। একটুও দেরি হয়নি তাঁর। আর সবার ওপর দীক্ষাগুরু সোহরাওয়ার্দী তো ছিলেনই। সে সময় সমগ্র ভারতে কংগ্রেস দলের ছিল খুব নাম-ডাক। অনেক মুসলমান ছিলেন কংগ্রেসের সদস্য। এমনকি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও একসময় কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, কংগ্রেস কখনো মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে একটি কথাও বলে নি! কংগ্রেস কখনো মুসলমানদের কথা বলবে না- এই বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯০৬ সালে গঠিত হয়েছিলো একটি পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন “নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’’। সে সময়কার বড় বড় সকল নেতারাই ছিলেন মুসলিম লীগের সদস্য। শেখ মুজিবুর রহমানও যোগ দেন মুসলিম লীগে। চালিয়ে যেতে থাকেন সভা-মিছিল। প্রথম সারির নেতাদের সাথে ঘুরে বেড়াতে থাকেন শহর থেকে গ্রামে-গ্রাম থেকে শহরে। ফলে নেতাদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ঠিকই, কিন্তু লেখা-পড়াই অমনোযোগী হয়ে পড়েন তিনি। রাজনীতিই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। একবার ছাত্রদের একটি প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে যাবার কথা। ছিলো খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবনে। তিনি তখন ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। রাত আটটার সময় ছাত্রদের প্রতিবাদ সভা শেষ হলে মিছিল নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, এ মিছিলের নেতৃত্ব দেবেন কে? ছাত্র মিছিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকে পড়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। তার উপর পুলিশের খাতায় নাম উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা তো ছিলোই। তাই নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে পাওয়া যাচ্ছিলো না কাউকেই। এমন সময় শেখ মুজিব মিছিলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, মিছিলটি কে নেতৃত্ব দেবে, এ নিয়ে এতো দ্বিধায় ভোগার কোনো মানে হয় না। আমরা আমাদের নায্য অধিকারের কথা, জানাতে যাচ্ছি আমাদেরই প্রধানমন্ত্রীকে। এটাতো কোনো আইন বিরোধী কাজ নয়। সুতরা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারো যদি কোনো আপত্তি না থাকে তবে আমিই দেবো এ মিছিলের নেতৃত্ব। অবশেষে তাই হলো, নির্ভীক মুজিবের নেতৃত্বে পঞ্চাশ জন ছাত্রের সেই মিছিল গিয়ে পৌঁছালো প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনে। তাদেরকে ডেকে নিয়ে বসানো হলো সুসজ্জিত বৈঠকখানায়। শেখ মুজিব কিন্তু দাঁড়িয়েই রইলেন অটল প্রহরীর মতো। তার এক কথা দাবি আদায় না হলে প্রধানমন্ত্রীর ঘরে বসবেন না তিনি। খাজা নাজিমুদ্দিন ঘরে ঢুকেই জানতে চাইলেন রাতের বেলা মিছিল নিয়ে তার বাড়ীতে আসার উদ্দেশ্য কি? এ প্রশ্নের জবাব দিতে সাহসই হলো না কারো। সবাই মুখ নিচু করে বসে রইলো। শেখ মুজিব তখন বললেন তাঁদের দাবি-দাওয়ার কথা। সব শুনে তুখোড় রাজনীতিক নাজিমুদ্দীন বললেন, আমি চেষ্টা করবো তোমাদের সমস্যার সমাধান করতে। এখন নিজ নিজ হোস্টেলে ফিরে যাও। মুজিব বললেন, আপনারা তো প্রতিশ্রæতি দিয়ে প্রতিশ্রæতি রক্ষা করেন না। নেতাদের কাছে মুসলমান ছাত্ররা শুধু বারবার প্রতিশ্রæতিই পেয়ে যাচ্ছে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। আমরা কি করে বুঝবো আপনি প্রতিশ্রæতি রক্ষা করবেন? শেখ মুজিবের এই নির্ভীক ও স্পষ্ট অভিযোগ শুনে স্বব্ধ হয়ে গেলেন খাজা নাজিমুদ্দীন। অবাক চোখে তিনি তাকিয়ে থাকলেন মুজিবের দিকে। তখন অন্যান্য ছাত্ররা অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনলেন সেদিন। পথে নেমে সিদ্ধান্ত হলো এবার সবাই মিছিল নিয়ে যাওয়া হবে সোহরাওয়ার্দীর পার্লামেন্টারি সেক্রেটারীর বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর কাছে তাঁকেই জানানো হবে ছাত্রদের সমস্যার কথা। বগুড়ার মোহাম্মদ আলীও ছিলেন ঝানু রাজনীতিবিদ। তিনিও মিষ্টি ভাষায় মিছিলকারীদের বিদায় করে দিলেন তাঁর বাসভবন থেকে। শেখ মুজিব বুঝতে পারলেন, এভাবে সমস্যার সমাধান হবে না। আন্দোলন চালাতে হবে আরো শক্ত হাতে তীব্রতর করে। এজন্যে নেতৃত্বের প্রয়োজন। বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ফজলুল কাদের চৌধুরীর তখন খুব নাম ডাক ছিলো ছাত্রনেতা হিসেবে। তিনি তখন আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়ছিলেন। থাকতেন কার মাইকেল হোস্টেলে। শেখ মুজিব সোজা চলে যান তার কাছে। তাঁকে খুলে বলেন সব কথা। আর ফজলুল কাদের চৌধুরীকে অনুরোধ করেন আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্যে। প্রথম দিকে অসম্মত হলেও মুজিবুরের অনুরোধ মেনে নেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। তার নেতৃত্বে সত্যি সত্যিই ছাত্রদের আন্দোলন জোরালো হয়ে ওঠে। আর বাধ্য হয় সরকার ছাত্রদের দাবি মেনে নিতে। শেখ মুজিব ছিলেন আপন আদর্শের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। কোনো লোভ বা ভয়-ভীতিই আদর্শ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে নি তাঁকে। ইসলামিয়া কলেজে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন শেখ মুজিব ছিলেন ফরিদপুর জেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক। আর সভাপতি ছিলেন কোলকাতার চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট নবাব জাদা লতিফুর রহমান। একবার তিনি প্রস্তাব করলেন সমিতির পক্ষ থেকে বাংলার নতুন গভর্নরকে সংবর্ধনা জানাতে হবে। কিন্তু মুজিব বললেন, অসম্ভব। এ হতেই পারে না। আমরা চাইছি ইংরেজ শাসনের অবসান। আমরা চাইছি এদেশ থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দিতে। সেখানে কি করে তাদেরকে সংবর্ধনা দেবো? এটা ভারতবাসীদের জন্যে একটা অপমান জনক অনুষ্ঠান হয়ে দাড়াঁবে আর আমাদের জন্যে হবে হঠকারী সিদ্ধান্ত। না, আমি একমত নই আপনার সাথে । লতিফুর রহমানও ছিলেন দেশদরদী রাজনীতিক। শেখ মুজিবের দৃঢ়তা আর সুচিন্তিত মতামত শুনে সেদিন আনন্দে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। তারপর বললেন, সত্যি, এমন গভীর করে ভেবে দেখেনি আমি। তোমার কথাই সত্যি। ১৯৪৬ সালের প্রথম দিকে সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে নির্বাচনী প্রচারনা চালাতে ফরিদপুর যান শেখ মুজিব। এটা ছিলো সাধারণ মানুষের সাথে পরিচিত হবার এক চমৎকার সুযোগ। মুজিবুর রহমানও খুব দক্ষতার সাথে কাজে লাগালেন সেই সুযোগ। ফরিদপুর জেলার প্রতিটি গ্রামে ঘুরে ঘুরে, পথে-প্রান্তরে ছুটে ছুটে প্রচারনা চালিয়ে যান মুসলিম লীগের পক্ষে। এতে মুসলিম লীগ শুধু দলগত ভাবে পরিচিতিই লাভ করে না- মুজিব নিজেও হয়ে ওঠেন সাধারণ মানুষদের কাছের মানুষ। গ্রাম-গঞ্জের খেটে খাওয়া মানুষদের সঙ্গে গড়ে উঠে তার বন্ধুত্বের সর্ম্পক। তার সাংগঠনিক দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হয়ে যান শেরে বাংলা ফজলুল হক আর নাজিমুদ্দীনের মতো জাঁদরেল নেতারাও। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রথম থেকেই নানাভাবে অনুপ্রাণিত করে ছিলেন শেখ মুজিবকে। মুজিবের ফরিদপুর প্রচারণার পর দু’জনার সর্ম্পক হয়ে উঠে আরো অন্তরঙ্গ আরো নিবিড়। একজন অন্যজনার হয়ে ওঠেন আরো কাছের মানুষ।