‘বাগেশ্বরী পাহাড়’: সাহিত্যের এক নবতর শাখা ‘ভ্রমণোপন্যাস’ কবি ও কথাসাহিত্যিক মুকুল রায় বর্তমান সময়ের একজন মননশীল ও শুদ্ধচেতনার লেখক। তাঁর সত্তরের দশকে বিকাশ এবং শূন্য দশকে এসে উত্তরণ। সৃষ্টি বয়স সাপেক্ষ নয়, শিল্প-সাহিত্য তো নয়ই। কোন বয়সে সৃষ্টির প্রাণবন্যা দুকূল ভাসিয়ে দেবে তা কেউই বলতে পারে না। মুকুল রায়ের ‘বাগেশ্বরী পাহাড়’ ভ্রমণোপন্যাসটিতে নৈসর্গিক প্রেমের চিত্র যেমন উপন্যাসের বহিরাঙ্গে প্রতিমা সুন্দরের ছবি আঁকা, অপরদিকে এর হৃদয়াঙ্গে ঢেলে দিয়েছে বাক্নান্দনিক কথাকলির মোহাচ্ছন্নতা, ধ্রুপদ রাগিনীর মীড় মূর্ছনা, যা অন্তরসত্ত্বায় নিবিড় প্রেম উল্লাসে বিকশিত। এ ভ্রমণোপন্যাসের বর্ণনায় লেখক যেন বেগবান নদীর ফল্গুধারা। উপন্যাসটিতে লেখকের ব্যক্তিজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। ভারতের বাগেশ্বরী পাহাড়, পাহাড় ছুঁয়ে উড়ে যাওয়া পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, বঙ্গাইগাঁও শহর, আর এই শহর ঘিরে যাপিত জীবনের দুঃখকে ভাগ করে নেওয়া কিছু মানুষ, দেশভাগের ফলে শেকড়চ্যুত বাস্তুহারা পূর্ব বাংলার বোহেমিয়ান বাঙালি, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা ভাগ্যান্বেষী অবাঙালি আর আসামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা সহজ-সরল অসমিয়া মানুষগুলোর নিত্যদিনের ছোট ছোট পাওয়া না পাওয়ার গল্প, হাসি-ঠাট্টা, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে ‘বাগেশ্বরী পাহাড়’ ভ্রমণোপন্যাসের মূল প্রেক্ষাপট। শেকড়হীন এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার তাগিদে একে অন্যের সহমর্মী হয়ে উঠেছে। তাদের ভেতর ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা জাতিগত কোনো দ্বন্দ্ব নেই। জীবনের তাগিদে জীবন এবং মানুষকে ভালোবেসে তারা গড়ে তুলেছে ভালোবাসার এক নতুন পৃথিবী। মুকুল রায়ের পাঠক নন্দিত এই ‘বাগেশ্বরী পাহাড়’ ভ্রমণোপন্যাসটির পাঠক প্রিয়তা কালজয়ী হবে বলে আমার বিশ্বাস। মুহাম্মদ নূরুল হুদা: জাতিসত্তার কবি, বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক।