অধ্যাপক আকমল হোসেনের এই স্মৃতিকথায় ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ কখনোই মুখ্য হয়ে ওঠেনি। বরং আকৈশোর যে রূপান্তর সমাজে দেখেছেন, চারদিকের অসঙ্গতিতে যে প্রশ্ন মনে জন্ম নিয়েছে, নিজের সক্রিয় সন্ধানে যে উত্তর খুঁজে পেয়েছেন, খেরোখাতায় স্মৃতিকথা তারই একটা আয়না। এই অর্থে নিজের স্মৃতিকথার ছলে আকমল হোসেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরই, আমাদের চেনা সমাজেরই একটা সময়ের চিত্র এঁকেছেন। তাঁর স্মৃতিকথাতে তাই সমাজ, রাষ্ট্র ও সমকালই প্রাধান্য পেয়েছে। অনাড়ম্বর সারল্য ও সততার সাথে তিনি বলে গেছেন তার কাটিয়ে আসা প্রায় ছয় দশকের ইতিহাস। অধ্যাপক আকমল হোসেনের এই স্মৃতিকথাতে ৫০-এর দশক থেকে ঢাকা শহরের একটা চিত্র পাওয়া যাবে। কৈশোর থেকেই তাঁর সমাজ বিষয়ে সচেতনতার স্ফুরণ ঘটেছিল বলে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনের একটা ছাপও এখানে গভীরভাবেই মিলবে। বহুমুখী দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন পর্ব কীভাবে তৈরি হয়েছিল, বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারার মাঝে বিতর্ক ও বিরোধের জায়গা কী ছিল, সেসব বিষয়ও গ্রন্থকার তুলে ধরেছেন তার নিজস্ব প্রেক্ষাপট থেকে। প্রসঙ্গক্রমেই লেখক উল্লেখ করেছেন তাঁর নিজস্ব সক্রিয়তার কথাও। মওলানা ভাসানীর রাজনীতির প্রতি তাঁর আকর্ষণের কল্যাণে রাজনীতির এই শক্তিমান প্রবাহটি নিয়ে এমন অনেক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিচারণ এবং মূল্যায়ন এখানে মিলবে, যেটা বাংলাদেশের ইতিহাসের অপেক্ষাকৃত অনেক কম আলোচিত অধ্যায়ের ওপর আলো ফেলেছে। কেবল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন শিক্ষক হিসেবেই নয়, এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত এবং জ্ঞানস্পৃহা ও জনমানুষের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ যে কয়েকজন বিরলপ্রজ মানুষ দেশবাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন, অধ্যাপক আকমল হোসেন সন্দেহাতীতভাবেই তাঁদের অন্যতম। তাঁর খেরোখাতায় স্মৃতিকথা গ্রন্থটি একদিকে আগ্রহী পাঠকের তৃষ্ণা মেটাবে, অন্যদিকে গবেষক, ইতিহাসবিদ ও অনুসন্ধানীদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হবে।
আকমল হোসেন ১৯৪৮ সালে ৮ সেপ্টেম্বর জন্ম গ্রহণ করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে ৩৭ বছর অধ্যাপনা শেষে ২০১৫ সালে অবসর নিয়েছেন। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং চেক রিপাবলিকের ইনস্টিটিউট অব স্টেট অ্যান্ড ল থেকে ১৯৭৭ এ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণা ও অধ্যাপনার বিষয় হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও আঞ্চলিক সহযোগিতা। আকমল হোসেন ভারত ও জাপানে ভিজিটিং প্রফেসর ও গবেষণা ফেলো হিসাবে কাজ করেছেন। দেশে-বিদেশে আন্তর্জাতিক সেমিনারে নিয়মিত অংশ গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারি, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কাউন্সিল সদস্য ছিলেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি শ্রেণীকক্ষের বাইরে তিনি একজন পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিস্ট হিসাবে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। বর্তমানে তিনি ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় কমিটি এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদের সভাপতি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ, জ্বালানী নিরাপত্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকনীতি; রাজনীতি সংস্কৃতি ও পররাষ্ট্রনীতি; Bangladesh Neighbours in India North East: Exploring Opportunities and Mutual Interest (ed.) এবং ‘কাশ্মীর দেশীয় রাজ্য থেকে কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চল প্রলম্বিত সংকটের আখ্যান’ অন্যতম।