একাকীত্ব আমি অণুরাধা রায়। সুনির্মল আমার খুব কাছের বন্ধু। সুনির্মলের সাথে আমার বন্ধুত্বের বয়স বেশীদিনের না। বন্ধুত্বটা হয়েছিল ফেসবুকের কল্যাণে মেসেঞ্জারের তুলনায় ফোনেই বেশী কথা হতো। প্রতিদিন নিয়ম করে রোজ একবার কথা হতো। আমি চাকরির প্রয়োজনে সিলেটে একটা বাসায় ভাড়া থাকতাম। বিধবা হওয়ার পর একমেয়েই আমার সব ভেবে কখনো দ্বিতীয় বিয়ের কথা চিন্তাও করিনি। গতবছর মেয়েটা যখন স্কলারশিপ নিয়ে ইউএসএ গেল তখন থেকে বাড়িতে একাই থাকি। সুনির্মলের সাথে সম্পর্কটা অনেক দূর অবধি গড়িয়েছিল। ও একদিন ফোন করে বলল, - আমি সিলেটে যাচ্ছি - হঠাৎ কেন? - যেতে পারি না? - পারো। কোথায় উঠবে হোটেলে? - না, তুমি থাকতে হোটেলে উঠবো কেন? - আমার এখানে? আশ্চর্য! - যাচ্ছি, রাত আটটার মধ্যে পৌঁছে যাব। ফেসবুকে অনেকবার ছবি আদান প্রদান হয়েছে। কিন্তু ওকে কখনো সরাসরি দেখিনি। সুনির্মলের সব পছন্দের খাবার নিজ হাতে রান্না করলাম। অনেকদিন পর খুব সাজতে ইচ্ছে করলো। একটা নীল রঙের শাড়ির সঙ্গে কপালে একটা লাল রঙের বড় টিপ পরলাম। ফোন করে আমার বাসার লোকেশনটা জানালাম সুনির্মলকে। রাত দশটায় বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে দিতেই সুনির্মলের হাসিমাখা মুখটা দেখতে পেলাম। সুনির্মল রাজশাহী তে একা থাকে। বছর সাতেক হলো ওর বউ ক্যান্সারে মারা গেছে। ওর এক ছেলে আছে; ছেলে-ছেলেবৌ ঢাকায় থাকে। ঘরে ঢোকার পরই ওর স্বভাবসুলভ উচ্ছ্বাস - বাহ তুমি তো ছবির চেয়েও বেশী সুন্দর দেখতে -বাজে কথা বাদ দাও। এখন ফ্রেশ হয়ে নাও। রাত হয়েছে আমি খাবার রেডি করছি। - আচ্ছা। ওর সব পছন্দের খাবার টেবিলে সাজিয়ে রাখলাম। এটা দেখামাত্রই ওর আনন্দ দেখে কে! - বাহবা, এতকিছু! বেকার তোমার ঝামেলা বাড়ালাম। - না, না তেমন কিছু না। কোন দরকারে এসেছো? - না, তোমাকে দেখতে আচ্ছা, অণু একটা কথা বলবো? - দুটোও বলতে পারো - আমরা কি নতুন করে শুরু করতে পারি? দেখ, “অস্ত গিয়েছে শরীরের চাহিদা, এই বয়েসে শুধুই প্রয়োজন একটু সঙ্গ”। এই বয়সে হিউম্যান টাচ খুব বেশী দরকার। এই একাকীত্বে তোমার শরীরটা না; তোমার সঙ্গটা চাই। আমি আর একা থাকতে পারছি না। আমি খুব ক্লান্ত। - ওহ, ভাতটা বাড়িয়ে দিচ্ছি। তরকারিগুলো তুমি নিজে তুলে নাও। যেটা মন চায় খাও। আজ সব খেয়ে উঠতে হবে কিন্তু তুমি আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছ কেন? - এতদিন পরে কি সেটা ভালো দেখাবে? সকলে কি বলবে? - লোকে কি বলল সেটা যায় আসে না। একটা জীবনে আমরা কতটা ভালো থাকবো সেটা একান্তই আমাদের নিজস্ব। তুমি একটু সম্মতি দিলে আমি আমার ছেলেকে জানাবো। তুমিও তোমার মেয়েকে জানাতে পারো? - সেটা পরে দেখা যাবে। তুমি কথা না বলে খেয়ে নাও - সেদিন যে গানটা শুনিয়েছিলে সেটা একটু শোনাবে?-কোনটা? - শুধু তোমার বাণী নয় হে বন্ধু হে প্রিয়... সেদিনের রাতে আমরা অনেকক্ষণ গল্প করছিলাম ব্যালকনিতে বসে। আকাশে রুপালি চাঁদ উঠেছে। কি স্নিগ্ধ ও শান্ত পরিবেশ! পরেরদিনে জরুরী টেলিফোন পেয়ে সুনির্মল রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা দিল। রাতে ফোন করতেই নাম্বারটা সুইচড অফ দেখালো। বারবার ট্রাই করলাম তবুও খোলা পেলাম না। দুদিন বাদে ফোন খোলা ওর ছেলে ফোন রিসিভ করে বলল, বাবা, আজ সকালে মারা গেছেন। সিলেট থেকে আসতে রোড এক্সিডেন্টে গুরুতর আঘাত পেয়ে আইসিইউ তে ভর্তি ছিলেন। তবে, সিলেটে কেন গিয়েছিলেন সেটা কেউ বলতে পারছে না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম! দীর্ঘশ্বাসের দীর্ঘতা কেবল আমিই অনুভব করতে পারি। আসলে, আমার ভাগ্যটাই খারাপ যাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই সেই দূরে চলে যায়। সুনির্মল তোমায় ভুলিনি, ভুলতে পারি না। যে একাকীত্ব ঘোচাতে তুমি আমার সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলে, সেই একাকীত্বেই আমি এখন খুব ক্লান্ত।