নারীকে সেই প্রাচীনকাল হতেই নানান উপাধি দেয়া হয়েছে সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতার সুবিধার্থে। যেমন আমাদের দেশে মায়ের মাতৃরূপকে খুব বেশি সামনে আনা হয়। স্নেহশীল, মমতাময়ী, সংসারে মানিয়ে চলার সহজাত মানসিকতা, ক্ষমাশীল... এভাবে নানান বৈশিষ্ট্য আরোপ করে নারীকে আলাদা মর্যাদা দিয়ে স্বার্থ আদায়ের চেষ্টা চলে সবসময়। এসব বিশেষণ অবশ্যই মিথ্যে নয়। কিন্তু এসবের ভেতর দিয়ে নারীর স্নেহশীলতার চরিত্রের পাশাপাশি যৌক্তিক কঠোরতা নারীতে বেমানান হিসেবে ধরে নেয় মানুষ। এভাবে মমতাময়ী বলে বলে মধুমুখে আরো একটা সেলাই দেয় সমাজ নারীর মুখে। আবার নারী সংসারে মানিয়ে চলতে অভ্যস্ত বলে বলে নিজ অধিকার আদায়ে দৃঢ়ভাবে না দাঁড়িয়ে বরং সকল অত্যাচার সহ্য করেই তাকে সংসারে মানিয়ে চলার উপদেশ পড়িয়ে-শিখিয়ে আরো একটা যুতসই সেলাই তার মুখে দিয়ে দেয় সমাজ। আবার নারীকে ক্ষমাশীল অভিধা দিয়ে পুরুষের সকল অন্যায়কে ক্ষমাশীলতার চাদরে মুড়ে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল প্রতিষ্ঠা করে শেষ সেলাইটা নারীর মুখে দেয়ার চেষ্টা করে সমাজ। সেলিনা হোসেন এসব বিষয় গভীর মননে পর্যবেক্ষণ করেই নারীদের জন্য কলম ধরেছেন। ধারালো ও স্পষ্ট শব্দে তিনি নারীর প্রতি সমাজ-রাষ্ট্র-পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গীর স্বরূপ তুলে ধরেছেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা ওই সব দৃষ্টিভঙ্গীর বিরুদ্ধে এক শান্ত কিন্তু দৃঢ় প্রতিবাদ আছে এ গ্রন্থে।
২১টি উপন্যাস, ৭টি গল্পগ্রন্থ ও ৪টি প্রবন্ধগ্রন্থের রচয়িতা সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। সমকালীন রাজনৈতিক সংকট ও দ্বন্দ্বের উৎস ও প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে সেলিনা হোসেন এর বই সমূহ-তে। সেলিনা হোসেন এর বই সমগ্র অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, রুশসহ একাধিক ভাষায়। প্রবীণ এ লেখিকা ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। সেলিনা হোসেন ১৯৪৭ সালের ১৪ই জুন রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। আদি পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীতে হলেও সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি তার। চাকরিসূত্রে তার বাবা রাজশাহী চলে এলে সেটিই হয়ে ওঠে সেলিনার শহর। স্থানীয় এক বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। আর ভালোবাসার টানে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সেলিনা হোসেন। এরপর সরকারি কলেজে শিক্ষকতা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনেও কাজ করেছেন তিনি। পাশাপাশি পত্রপত্রিকার জন্য চালিয়ে গেছেন তার কলম। টানা ২০ বছর তিনি ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেলিনা হোসেন মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রচনা করে পাঠকমনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তার রচিত মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক কালজয়ী উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। ‘যাপিত জীবন’, ‘ক্ষরণ’, ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’, ‘যুদ্ধ’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ (তিন খণ্ড) ইত্যাদি তার জনপ্রিয় উপন্যাস। ‘স্বদেশে পরবাসী’, ‘একাত্তরের ঢাকা’, ‘ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন’ ইত্যাদি তার জনপ্রিয় প্রবন্ধ। কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘চাঁদের বুড়ি পান্তা ইলিশ’, ‘আকাশ পরী’, ‘এক রূপোলি নদী’ সহ বেশ কিছু সুপাঠ্য গ্রন্থ। সাহিত্যাঙ্গনে এই অনবদ্য অবদানের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়াও তিনি ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’, ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’, ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ সহ অসংখ্য পদক পুরস্কার পেয়েছেন।