অপরাজিত বিভূতিভূষণের অনবদ্য এক সৃষ্টি। অনেক সময়ই একটি ব্যাপার লক্ষ করা যায়, উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব প্রথম পর্বকে মান বা জনপ্রিয়তার বিচারে ছাপিয়ে যেতে পারে না। তবে অপরাজিত এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম। পথের পাঁচালী-র পরের পর্ব হিসেবে প্রকাশিত হওয়া এই উপন্যাসে বিভূতি তার পাঠকদের চোখে অপুর কৌতূহল, বিস্ময় ও বোধশক্তির মিথস্ক্রিয়া... তার আশ্চর্য হবার যে বোধশক্তি, যা কিনা সাধারণকেও দীপ্তিমান করে তোলে... এছাড়া অজানার প্রতি তার যে দুর্বার আকর্ষণ- তা ফুটিয়ে তুলতে পুরোপুরি সফল হয়েছেন। অপরাজিত একই সঙ্গে ক্ষয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অগ্রগতির উপন্যাস। আমরা কী চাই, আর তার জায়গায় কী পাই- এ দু'য়ের পার্থক্য এই উপন্যাস আমাদের দেখায়। অপরাজিত আমাদেরকে দেখায়, আগে থেকেই আন্দাজ করে বসে থাকা জীবনের চেয়ে জীবন কতটা ভিন্নরকম হতে পারে। এ উপন্যাস আমাদেরকে বার্তা দেয়, যে মানুষ অতীতকে গৌরবোজ্জ্বল বা ভবিষ্যতের ব্যাপারে বেশি না ভেবে বর্তমানে বাস করে সেই সুখে থাকতে পারে। অপরাজিত অপুর উপন্যাস। অপুর অসাধারণ জীবনকে কলমে তুলে ধরা হয়েছে এ উপন্যাসে। জীবন তার দু'হাতে হাজার সমস্যা অপুর দিকে বাড়িয়ে দিলেও সে হার মানেনি। অপরাজিত হয়েই সে বিচরণ করে গেছে জীবনের অলিগলিতে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।