মানুষের জীবন ও জীবিকা, আচার ও আচরণ, সুখ ও দুঃখ নিয়ে রচিত এককালের লোকসাহিত্য ঈশ্বরপ্রেম, সৃষ্টিতত্ত্ব জীবে-জীবে প্রেম ইত্যাদির মূল্যবোধে সৃষ্টি হয়েছে মরমি সাহিত্যের। এ পৃথিবী নশ্বর বা অনিত্য, এখানের বাসিন্দাদের মিলে মিশে একে অন্যের সাথে জীবনযাপন করার নামটিই হচ্ছে প্রেম। প্রেমকে জাগ্রত করে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ীত্ব করাটাই হচ্ছে মরমি মতবাদের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সিলেটাঞ্চলের মরমি গীতিকার প্রকারভেদে ভিন্ন। তাই এগুলোকে এ অঞ্চলে সিলেটের মরমি সাহিত্য বলে আখ্যায়িত করা হয়। শ্রী চৈতন্যদেব, হযরত শাহজালাল (র.) সহ ৩৬০ আউলিয়ার ভূমি সিলেট বিভাগই এর বিকাশস্থল। এজন্য সিলেটকে বলা হয় বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী। যুগ যুগান্তর ধরে সুফি, ফকির, পীর ও আউলিয়ার ক্রমধারায় সিলেটে জন্ম হয়েছে বেশুমার ভাবুক, কবি ও সাধকদের। যাঁরা সুর মুর্ছনার মধ্য দিয়ে মানুষকে দেখিয়েছে পরমাত্মাকে পাওয়ার পথ। সংগীত এবং মরমি কবিদের জন্য সিলেট অঞ্চল পরিচিত। রাধারমণ দত্ত, শাহ আবদুল করিম, শীতলংশাহ, দ্বীন ভবানন্দ, হাসন রাজা, আরকুম শাহ, দূর্বিন শাহ প্রমুখ রচিত মরমি গানগুলি সিলেটিদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় যা সিলেটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমূহে উপস্থাপিত হয়। হাসন রাজার মরমি ও আধ্যাত্মিক গান, লোকে বলে বলে রে / ঘর-বাড়ি ভালা নায় আমার; সোনা বন্ধে আমারে দিওয়ানা করিলো; আঁখি মুদিয়া দেখো রূপ; নেশা লাগিলো রে / বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিলোরে সহ গানগুলো ঐতিহ্যবাহী সিলেটিতে রচিত হলেও সমগ্র বাংলাদেশে ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছে। তিনি সিলেটি ভাষায় প্রায় এক হাজার মরমি সংগীত রচনা করেছেন, যা সমগ্র দেশজুড়ে বিখ্যাত। ইতিহাস অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, মধ্যযুগের শুরু থেকে সিলেট অঞ্চলে জন্ম হয়েছে প্রখ্যাত, অজ্ঞাত অনেক মরমি সাধকদের। যাঁরা হৃদয় বীণার তারের সুরে ও ছন্দে রচনা করেছেন ঈশ্বরপ্রেমসহ সৃষ্টির উপর অসংখ্য গীত। সমীরণ দাস তেমনই একজন। গানের সাথে সমীরণ দাসের সম্পৃক্ততার অনেক সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রামে মনসাদেবীর পুজো হলেই পিতামহ দীনদয়াল দাসকে পাওয়া যেতো পদ্মপুরাণের আসরে। সমীরণ দাসের পিতা দূর্গাপ্রসাদ দাস গানের জন্য ছিলেন এলাকাখ্যাত। ধারণা করা যায় পিতা, কাকামশাই ও বড়ভাইদের গানের সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থেকেই সমীরণ দাসের হৃদয়ে গান রচনার আগ্রহ জেগে ওঠে। বাল্যকালে পিতার কাঁধে চেপে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে পদ্মপুরাণ পাঠ দেখতে যেতেন। এভাবেই তাঁর সাথে একে একে পরিচয় ঘটতে থাকে ভজনগান, নাম সংকীর্তণ, উচ্চ-কীর্তণ, আরতি, পালাগান, যাত্রাগান, বাউলগানসহ বিভিন্ন লোকগানের সাথে। এরইমাঝে তিনি নিজে গান লেখা শুরু করেন এবং গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেগুলো গাওয়া হতে থাকে। সেসব গান তখন সংগ্রহ করে রাখা হয়নি, যার ফলে হারিয়ে গেছে চিরতরে। একসময় পিতার প্রয়াণের পর সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। বেশ কিছু বছর তিনি সরে দাঁড়ান গানের এই আধ্যাত্মিক জগৎ থেকে। জীবন ও জীবিকার সন্ধানই তখন হয়ে দাঁড়ায় তাঁর একমাত্র সংগ্রামের বিষয়। পরিবারের ব্যয়ভার বহনের ফাঁকেও তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যান। জীবনের এই কঠিন থেকে কঠিনতর লড়াইয়ের মাঝে ১৯৭৫ সালে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপজেলা কার্যালয়ে অফিস সহকারি কম্পিউটার অপারেটর পদে যোগদান করেন। পারিবারিক জীবনে সমীরণ দাস একজন সফল ব্যক্তি। স্ত্রী রীণা দাস প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। দুইমেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং একমাত্র ছেলে উপজেলা পরিষদে কর্মরত। ২০১৫ সালে তিনি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং গান রচনায় মনোনিবেশ করেন। “গীতমাধুরী” গ্রন্থে ১৯৬ টি গানের সংকলন করা হয়েছে। ধামাইল গান, ভজন গান, শ্যামা সংগীত, আঞ্চলিক গান ছাড়াও কিছু দেশের গান এতে সংকলিত করা হয়েছে।