আমার বইটা পড়িবার সময় একটি দেশি ও একটি বিদেশি উক্তি মনে রাখিতে বলিব। দেশিটি এই- “নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন । যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্য- স্তস্যৈষ আত্মা বিবৃণুতে তনুং স্বাম্ ॥” আত্মার সম্বন্ধে যাহা বলা যায়, যে-কোনো বিষয়ে সত্য আবিষ্কার সম্বন্ধে তাহাই বলা চলে-শুধু বুদ্ধি ও তর্কের দ্বারা সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। বাঙালি শিক্ষিত সমাজের সবচেয়ে বড় দৈন্য ঊষর তর্কপ্রবণতা, হৃদয়হীনতা দ্বিতীয় কথাটি হৃদয় ও বুদ্ধির সম্পর্ক সম্বন্ধে। উহা প্যাস্কালের উক্তি- Le coeur a ses raisons, que la raison ne connait point: on le sait en mille choses. (হৃদয়ের যুক্তি আছে কিন্তু তাহা যুক্তির একেবারে অগোচর। ইহা সহস্র ব্যাপার হইতে জানা যায়।) সুতরাং বাংলাদেশে যাঁহারা পণ্ডিত বলিয়া খ্যাত আমার বই তাঁহাদের জন্য নয়, যে-বাঙালির এখনও হৃদয় আছে তাঁহারই জন্য। আশা করি এত দুঃখকষ্টেও বাঙালির হৃদয় একেবারে শুকাইয়া যায় নাই । কিন্তু তাই বলিয়া বই লিখিবার অধিকার আছে তাহা জোর করিয়া বলি না। বাংলাতে বই লিখিবার কারণ আমার দিক হইতে সরলভাবে জানাইতেছি। এ পর্যন্ত আমি বাংলা বই লিখি নাই, এই আমার প্রথম বই। পঞ্চাশ বৎসর বয়সে ইংরেজিতে প্রথম বই লিখতে আরম্ভ করিয়াছিলাম, সত্তর বৎসর বয়সে বাংলায় লিখিলাম। ইংরাজির বেলাতেই দেরি হইয়া গিয়াছে মনে করিয়াছিলাম, সুতরাং বাংলার ক্ষেত্রে আরও কত দেরি যে হইয়া গিয়াছে তাহা মনে করিতেও ভীতি হইতেছে।
Nirodchandra Chowdhury (জন্ম: ২৩ নভেম্বর, ১৮৯৭ - মৃত্যু: ১ আগস্ট, ১৯৯৯) একজন খ্যাতনামা দীর্ঘজীবী বাঙালি মননশীল লেখক ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ। স্কলার এক্সট্রাঅর্ডিনারী শীর্ষক ম্যাক্স মুলারের জীবনী লিখে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে নীরদচন্দ্র চৌধুরী ভারত সরকার প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মাননা হিসেবে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি তাঁর ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও তীর্যক প্রকাশভঙ্গীর জন্য বিশেষভাবে আলোচিত ছিলেন।