ভাটি বাংলার সন্তান শ্রীকান্ত দাশের নামের সাথে মিশে আছে ‘কমরেড’ অভিধা, যতটা না পোশাকি, তার চেয়ে বেশি হৃদয়-উৎসারিত, এলাকাবাসীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার স্বীকৃতি-স্বরূপ। একান্ত সহজিয়াভাবে তিনি আলিঙ্গন করেছিলেন মানুষের মুক্তির প্রয়াস, যা রূপায়িত হয়েছিল লোকগানের ধারায়, হাওর-বেষ্টিত সুনামগঞ্জ অঞ্চলে যে-সুর ভেসে বেড়ায় আকাশে-বাতাসে। সেই সাথে তিনি পেয়েছিলেন ‘কৃষকদের বন্ধু করুণা সিন্ধু’র সান্নিধ্য, যা শোষিত-নিপীড়িত মানুষের জীবনে পালাবদল ঘটাতে তাঁকে উদ্দীপ্ত করেছিল। চল্লিশের দশকের গোড়ায় সঙ্গীত ও সমাজমুক্তির যুগল মন্ত্রের যে দীক্ষা তিনি গ্রহণ করেছিলেন নিষ্ঠার সাথে আজীবন করে গেছেন সেই সাধনা। এই সময়ে দেশ-সমাজ ও রাজনীতিতে নানা পরিবর্তন ঘটেছে, তবে তিনি কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি, কর্মে ও সৃজনে ছিলেন একই পথের পথিক। তাঁর সুদীর্ঘ জীবন-সাধনার স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন মানুষের বিপুল ভালোবাসায় নন্দিত হয়ে, এই স্মারক গ্রন্থ যার যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় মেলে ধরে। পাদপ্রদীপের আলোর বাইরে প্রান্তবাসী এই শিল্পী-সংগ্রামী বাংলার লোকজীবনের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক, যে-জীবন সৃজন-দক্ষ এবং সংগ্রামে অবিচল। জীবনভর মানুষকে যে ভালোবাসা তিনি উজাড় করে দিয়েছেন, ২০০৪ সালে মরণোত্তর দেহদানেও ছিল যার অসামান্য প্রকাশ, সেই সংগ্রামী কমরেড আবারও মানুষের ভালোবাসায় উদ্ভাসিত হলেন বর্তমান স্মারক-গ্রন্থের মাধ্যমে।
তাজুল মােহাম্মদ সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ১৯৭২ সালে। আর মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার কাজে হাত দেন ১৯৭০ সালে। তখন থেকেই লেখালেখি করছেন এ বিষয় নিয়ে। ১৯৮৯ সালে। প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় “সিলেটে গণহত্যা'। এ গ্রন্থের সুবাদে ব্যাপক পরিচিতি। সিলেটের যুদ্ধ কথা’-সহ আরও চার-পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৪ সাল অবধি। সিলেটের গণহত্যা নিয়ে ব্যাপক আলােচনার কারণেই হয়তাে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। ব্রিটেনের টুয়েন্টি টুয়েন্টি টেলিভিশনের। যােগাযােগ করে সে টিভি কর্তৃপক্ষ। নিয়ােগ করে যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে গবেষণার কাজে। ৯ মাসের গবেষণার ফল হিসেবে নির্মিত হয় ‘দা ওয়ার ক্রাইম ফাইল’ নামক প্রামাণ্য চিত্র। যা সাড়া জাগিয়েছিল বিশ্বের দেশে-দেশে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশে, ব্রিটেনে, যুক্তরাষ্ট্রে। এর আগেই তাজুল মােহাম্মদের ওপর হুমকি আসে মৌলবাদী, যুদ্ধাপরাধী এবং জামায়েত শিবিরের পক্ষ থেকে। এক সময় দেশ ছেড়ে পালাতে হয় তাকে। দেশের বাইরে থেকেও আন্দোলন করেছেন তিনি। বসতি গড়েছেন কানাডায়। বছরে কয়েক মাস দেশে অবস্থান করে চালান গবেষণাকর্ম। বাকি সময় কানাডায় বসে লেখালেখি করেন। গ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে ষাটের অধিক। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার জন্য লাভ করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। পেয়েছেন ইংল্যান্ডের টাওয়ার হ্যামলেটস মেয়র অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কিছু সম্মাননা। গবেষণা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন যুবকের ন্যায়। তাজুল মােহাম্মদের জন্মস্থান মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায়। পরে থিতু হয়েছিলেন সিলেট শহরে।