বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য গ্রন্থ লেখা হলেও মুক্তিযুদ্ধের অনেক অবিদিত ইতিহাস আজও জনসম্মুখে আসেনি নানা প্রতিকূলতায়। আঁধার থেকে আলোয় গ্রন্থটি তেমনই একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ বটে। কেননা পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙালি যুদ্ধবন্দিদের অব্যক্ত পলায়ন কাহিনি সুদীর্ঘ ৪৪ বছর পর লেখক গ্রন্থকারে জনসম্মুখে প্রকাশ করলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং এর পরের বন্দি জীবনের দিনগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত সেনা ও নৌবাহিনীর অফিসাররা কি নিদারুণ পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন, এই গ্রন্থে সেই অজানা কাহিনি বিবৃত হয়েছে। বন্দি শিবির থেকে সেনা কর্মকর্তাদের স্থানান্তর করতে কড়া পাহারায় ট্রেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় মেজর মান্নান ট্রেন থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু তার উর্দুভাষী ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত বন্ধুর (পাকিস্তানি) সহযোগিতা চাইলে সেই বন্ধু বরং বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে ধরিয়ে দেয়। আর এই ঘটনাই প্রমাণ করে দেয়, দেশভাগ ও জাতিসত্তাবোধে কেউ তার প্রতিপক্ষকে বিশ্বস্ত মনে করে না। অতঃপর পুরোনো বন্দি অফিসারদের সঙ্গে লেখকের কারাজীবন শুরু হয়। লেখক এস এম কবির ও মেজর মান্নানসহ ১০ জন এক সময় জেল থেকে পালানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। এরপরই ঘটতে থাকে একের পর এক দুঃসাহসিক ও শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনা। যে ইতিবৃত্ত জানলে পাঠক শিউরে উঠবেন আপন মনেই। এ ছাড়া আছে নৌবাহিনীর নিজস্ব রণকৌশলের বর্ণনা। মাতৃভূমিতে ফিরে আসার স্বপ্নকে কীভাবে বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন তারা মৃত্যুর ভয়কে উপেক্ষা করে, সেই কাহিনি জেনে নিতে হবে পাঠককে। এ আবেগ বর্ণনাতীত। তাই সুদীর্ঘ সাড়ে চার দশক পর লেখক এস এম কবির প্রবল দেশপ্রেমের টানে প্রচ- আবেগে যথার্থই বলেছেনÑ “প্রতি বছরই ফিরে আসে ৯ ও ১০ই এপ্রিলের রাত। আমাদের জীবনে এগিয়ে যায় আরও একটি বছর। তবুও সে রাতে আমরা ফিরে যাই তারুণ্যে। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি মধ্যরাতের জন্য। সেই মুহূর্ত, সেইক্ষণ, সেই দুঃসাহস, সেই রোমাঞ্চপূর্ণ মুহূর্ত মনে হয়, এই বুঝি পেছনে বেয়োনেট ঝলসে উঠছে, কুকুরটি হয়তো এখনই আমার ওপর লাফিয়ে পড়বে। সার্চলাইটের আলোতে ধরা পড়লাম হয়তো, দৌড়ে এসে জীবনের হুমকি থেকে বেঁচে আসা বন্ধু বুঝি ধরাই পড়ে গেল অথবা ভেসে যাচ্ছি রাভি নদীর প্রবল স্রোতে।” “জীবন ছিনিয়ে নিতে প্রহরীর একটি বুলেটই যথেষ্ট ছিল। পথিমধ্যে ধরা পড়লে কি যাতনাই না ভোগ করতে হতো! হয়তো কোনোদিন দেখতে পেতেন না প্রিয় এই জন্মভূমিকে মায়ের রূপেÑ হয়তো দেখতেন না বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন তথা বাঙালি জাতির স্বপ্ন স্বাধীন এই বাংলাদেশÑবীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশÑআমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ! কোথায় থাকত সেই দুঃসাহসিক অভিযানÑকোথায় পাওয়া যেতো সফলতার গৌরব এবং জীবন সায়াহ্নে অপার আনন্দ।”