শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী। কিন্তু উপন্যাস রচনায় তিনি যতটা সফল গল্পের ক্ষেত্রে ততটা নয়। তিনি নিজেই বলেছিলেন, গল্পগুলো তাঁর হাতে কেমন বড় হয়ে যায়। গল্প রচনার সময়ও মনের গভীরে বক্তব্য একটা তার থাকেই; এবং তা স্পষ্ট না করে তোলা অবধি তিনি থামতে পারতেন না। ভাবনার বিন্যাসে রসাবেদনে শরৎচন্দ্রের গল্প ঠিক Short Story-র সংজ্ঞার সঙ্গে মেলে না। মনেহয় গল্পগুলিকে বিস্তৃত করে উপন্যাসে রূপ দিতে পারতেন সহজেই। কিন্তু বাঙালী জীবনকে যে নিপুণতার সঙ্গে আঁকতে পারেন এই কথাশিল্পী তাতে গল্পে-উপন্যাস সবই সমান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শরৎচন্দ্রের প্রথম দিকের লেখায় ছোটগল্পের রূপ অনেকটা ধরা পড়েছে। প্রথম গল্প যদিও ‘কাশীনাথ’ কিন্তু তিনি গল্পকার হিসাবে প্রথম 'কুন্তলীন' পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ‘মন্দির’ গল্পের জন্য। এ গল্প অবশ্য তখন স্বনামে ছাপাননি। সেদিন অনেকেই ভাবতে পারেননি এই গল্পকারই একদিন রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তাকেও ছাপিয়ে যাবেন। ১৯০৭ সালে ‘ভারতীয়’ পত্রিকায় ‘বড়দিদি' নামক বড় গল্পটি প্রকাশিত হলে এর অপূর্বতাকে দেখে অনেকেই মনে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথই বুঝি ছদ্মনামে এ গল্প লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পড়ে বললেন, 'এ গল্প যিনিই লিখুন, তিনি এক অসাধারণ শিল্পী।” এখানেই কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের প্রথম সার্থক স্বীকৃতি। শরৎচন্দ্রের যে গল্পগুলিতে ছোটগল্পের রস ফুটছে সেগুলি হল—‘বিন্দুর ছেলে’ (১৯১৪), ‘রামের সুমতি’ (১৯২৪) ‘মেজদিদি’ (১৯১৫), ‘মামলার ফল’ (১৯২০), ‘হরিলক্ষ্মী’ (১৯২৬), ‘পরেশ’ (১৯২৪) প্রভৃতি গ্রন্থগুলিতে। ‘বিন্দুর ছেলে’ রচনাটিতে ছোটগল্পের এককেন্দ্রিক বিষয়াভিমুখিতা ঘন হয়ে আসছিল। নাটকীয় উৎকণ্ঠায় ভরে পাঠকের মন তার হাতের মুঠোয় চলে আসছিল। বিন্দুর স্বামী ভোর রাতে যাদব-অন্নপূর্ণার কাছে খবর নিয়ে এলেন, পিত্রালয়ে বিন্দু মৃত্যুপথযাত্রায়; অমূল্যকে নিয়ে গাড়ি ছলটো শেষ দেখেতে। পাঠকও উদগ্রীব। কিন্তু শিল্পীর মেজাজ গল্পরস সম্পূর্ণ হতে দিল না। ছোটগল্পের শেষের যে ব্যঞ্জনা তা শরৎচন্দ্রের গল্পে দেখা যায় না। গল্পের শেষে দিব্যি দিলেশার জট খুলে যেতেই অন্নপূর্ণার দিকে চেয়ে বিন্দু বলে, "দাও দিদি, কি খেতে দেবে? আর অমূল্যকে আমার কাছে শুইয়ে দিয়ে তোমরা সবাই বাইরে গিয়ে বিশ্রাম কর গে। আর ভয় নেই—আমি আর মরব না।” গল্প যেন নতুন করে উপন্যাসের পূর্বসূচনা দিয়ে শেষ হয়। ‘রামের সুমতি’ ও ‘মেজদিদি’ গল্পে গল্পরস একইভাবে এগিয়ে গেলেও রবীন্দ্রগল্পের মতো— ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’ এই ব্যঞ্জনা কোথা? গল্প হিসাবে শরৎচন্দ্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় 'অভাগীর স্বর্গ' এবং 'মহেশ'। গল্প হিসাবে শরৎচন্দ্রের এই দুটিই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র দুলেঘরের দুখিনী স্বামী পরিত্যক্তা কাঙালীর মা’, যথার্থই অভাগী। অভাগী জীবনে কিছুই পায়নি। তার শেষ প্রত্যাশাও ছিল জগতের ভোগ্যবস্তুর তুলনায় তুচ্ছ। পুত্রের হাতে তার চিতা জ্বলবে –এই সামান্যতম ইচ্ছাটুকু পূরণ করতে গিয়ে দরিদ্রঘরের কাঙালিচরণ মনুষ্যত্বহীন সমাজের দ্বারা চরমভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে। অথচ জমিদার গৃহিণীর শেষকৃত্যে কি বিপুল সমারোহই না হয়েছিল। সুসংহত গল্প হিসাবে গল্পটি নিঃসন্দেহে সার্থক। দারিদ্র মানুষের কাছে ইহ জীবনে যেমন যন্ত্রণার শেষ থাকে না, তেমনি পরলোকে স্বর্গের প্রত্যাশাও যেন বাহুল্য। বিবেকহীন সমাজ মানুষের মৃত্যুপরবর্তী প্রত্যাশাকেও ছিনিয়ে নিতে চায়। কিন্তু কাঙালীচরণ এই বিবেকহীন সমাজের কাছে নির্দিষ্ট কোন জিজ্ঞাসা রেখে যায় না, নির্বিকারে এই নিষ্ঠুরতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। পাঠক কিন্তু এই গল্পের ব্যঞ্জনা আস্বাদ করতে পারে—এখানেই গল্পটির সার্থকতা। ‘মহেশ' শরৎচন্দ্রের আর একটি সামাজিক দলিল। গফুর মিয়া, আমিনা ও মহেশকে নিয়ে চমৎকার গল্পের পটভূমি তৈরী করেছেন গল্পকার। শত দারিদ্রের মধ্যেও গফুর—আমিনা বাঁচিয়ে রেখেছিল মহেশকে। শেষে গফুরের হাতে মহেশের মৃত্যু চরম ট্র্যাজিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। কিন্তু গল্পকারের সেই অতৃপ্ত মেজাজ গল্পকে এখানে শেষ হতে দেয়নি। নতুন জীবনের সন্ধানে গফুর আমিনার হাত ধরে চটকলের শ্রমিক হতে চলেছে। এখানেই ছোটগল্পের এককেন্দ্রিকতা ক্ষুণ্ণ হয়। গল্প বিস্তৃত হয়ে নতুন উপন্যাসের বহুমাত্রিক পটভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে চায়। সুতরাং গল্প রচনায় শরৎচন্দ্রের সমস্যা ছিল শুধু ছোটগল্পের পরিসর নিয়ে নয়, শিল্পীর মেজাজের গভীরেই ছিল সমস্যা। কিন্তু তাই বলে অমর কথাশিল্পীর জনপ্রিয়তা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি। কারণ মানবজীবনের সুখদুঃখ ও অশ্রুবেদনাকে এমন সহানুভূতির রসে ডুবিয়ে এমন স্নিগ্ধ মধুর ও বেদনাবিধুর কাহিনী বাংলা সাহিত্যে আর কেউ লিখতে পারেননি। আর এই প্রবল সহানুভূতি ও আবেগই ছোট গল্পকারের সংযম শক্তিকে পরাজিত করেছে। গল্প রচনায় শরৎচন্দ্রের সমস্ত ত্রুটিকে ঢেকে দিয়েছে গল্পের বিষয় গৌরব। গল্প ও উপন্যাস রচনায় স্পষ্ট কোন ভেদচিহ্ন রচনা করতে পারেননি।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।